অস্তিত্ব থেকে আমার উন্মেষ

রাতের নিস্তব্ধতায় বাতাস যখন সঙ্গীতের মতো শীতলভাবে দেহের ভেতর ঢুকে যায়, তখন আমার অনস্তিত্ব ধীরে ধীরে অচেতন ইচ্ছার গহ্বর থেকে উঠা এসে আমার অস্তিত্বের শিরায় প্রবাহিত হয়। রাতের অন্ধকারে চাঁদ যেমন তার আলোকে ছিঁড়ে আনে এবং সমুদ্রের তরঙ্গকে নাড়িয়ে তোলে, তেমনি আমার অনস্তিত্ব থেকে অস্তিত্বের জন্ম হয়।

এ জন্ম কেবল ব্যক্তিগত নয়—এটি ইতিহাসের প্রতিধ্বনির সংমিশ্রণ, ভবিষ্যতের অজানা সীমানার সাথে সংযোগ এবং অতীতের অমোঘ ছায়ার সাথে লড়াই।

অস্তিত্বের আগে আমি ছিলাম অন্ধকারের গর্ভে, যেখানে সময়ও নিঃশ্বাস নেয় না। সেখানে আমি ছিলাম না, অথচ আমার সম্ভাবনা জেগে ছিল মহাশূন্যের নিস্তব্ধতায়। প্রথম নিঃশ্বাসের আগে আমি ছিলাম শূন্যতায় বন্দী। কোনো অনুভূতি নেই, কোনো শব্দ নেই, কোনো রঙ নেই—কেবল ঘুটঘুটে অন্ধকার। অস্তিত্বের দিকে আমি যখন একটু একটু করে এগোই, তখন ধীরে ধীরে অনুভব করি—জীবনের প্রত্যেকটা ‘মুহূর্তই’ মৃত্যু এবং জন্মের মধ্যে ঝুলে আছে।

আমার বর্তমান অস্তিত্ব কেবল উপস্থিতি নয়; এটি হলো চেতনাশীল দার্শনিকের যাত্রা। আমি দেখি পৃথিবীকে তার হাড়ভাঙা সত্যে— ভালো-মন্দ, জীবন-মৃত্যু, সুখ-দুঃখ সবকিছু এক রক্তমাখা ছায়ার মতো। পৃথিবীর প্রতিটি রঙ, প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি শূন্যতা আমাকে প্রশ্নে নিমজ্জিত করে। আমি হেসে উঠি, কিন্তু হাসিটিও ভয়ের ঘ্রাণ ধরে রাখে। আমি আছি শুধুমাত্র নিজের মধ্যে নয়; আমি আছি সময়ের সীমাহীন নদীতে, যেখানে প্রতিটি মুহূর্ত একটি কণার মতো ছিন্ন হয় এবং আবার মিলিত হয় মহাবিশ্বের বুকে।

আমার প্রতিটি ভাবনা একটি তারা, যা আকাশে নিজস্ব আলো ছড়ায়; প্রতিটি অনুভূতি একটি নক্ষত্র, যা অজানা পথকে আলোকিত করে। এই প্রক্রিয়ায় আমি শিখি, যে অনস্তিত্বের মধ্যে নিহিত শক্তিই আমাকে আমার অস্তিত্বের অর্থ দেয়। আমি শিখি, অনুভূতির গভীরতা ছাড়া ভাবনা শূন্য। আমার ভাবনা আবার কখনও কখনও এক অদৃশ্য আগ্নেয়গিরির মতো ফেটে ওঠে, যার গরম এবং আলো আমার মনকে জ্বালিয়ে দেয়। আবার ঠান্ডাও করে।

আমার ভাবনা কেবল ব্যক্তিগত নয়; এটি সমগ্র মানবজাতির অন্তর থেকে উদ্ভূত। প্রতিটি আবেগ, প্রতিটি ক্ষণিকের দ্বন্দ্ব, প্রতিটি প্রতিফলন—এগুলি সমস্ত একত্রিত হয়ে একটি মহাজাগতিক ভাষায় পরিণত হয়। আমি নিজেকে হারাই, আবার খুঁজে পাই; আমি নিঃশেষে পৌঁছাই, আবার শুরু করি। এই চলমান প্রক্রিয়াই আমাকে করে তোলে জীবন্ত, যদিও আমি জানি প্রতিটি মুহূর্তে মৃত্যু আমাকে অবিরত অনুসরণ করে।

আজ আমি বর্তমানের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে। আলো দেখি, অন্ধকার দেখি, ভালো-মন্দের সংঘাত দেখি। কিন্তু সবকিছুর ভেতরেই রয়ে গেছে অনস্তিত্বের ছায়া। আমার প্রতিটি শ্বাস আসলে আমার মৃত্যু থেকে চুরি করা কিছু সময়। প্রতিটি দিন আসলে মৃত্যুর সাগরে ঝরে পড়া এক ফোঁটা জল। আমি যাকে বলি জীবন, সেটি তো মৃত্যুর আলিঙ্গনের দিকেই অগ্রসরমান এক ক্ষণস্থায়ী প্রহসন। অথচ এই প্রহসনের ভেতরেই আমি হেসে উঠি, কাঁদি, ভালোবাসি, ঘৃণা করি, সৃষ্টি করি।

আমি ভাবি— কেন আমি এসেছি? কিসের জন্য এসেছি? আমি কি কেবল ধূলিকণার মতো এক মুহূর্তের জন্য জ্বলে উঠেই নিভে যাব? আমার এই প্রতিটি ভাবনা আমাকে তাড়া করে, আমাকে কুরে কুরে খায়, আবার আমাকে উজ্জ্বলও করে।

আমার অনস্তিত্ব আমাকে শূন্যতার স্বাদ শিখিয়েছে, আমার বর্তমান আমাকে জীবনের ভ্রম শিখাচ্ছে, আমার ভাবনা আমাকে অনন্ত জিজ্ঞাসার গহ্বরে নিক্ষেপ করছে, আর আমার ভবিষ্যত জীবন আমাকে শিহরিত করে রেখেছে এক অবর্ণনীয় রহস্যে। আমি বুঝি, সময়ের প্রতিটি স্রোত একেকটি জন্ম ও মৃত্যুর খেলা, আর প্রতিটি মুহূর্ত একেকটি নতুন প্রস্থান ও আগমনের মতো। জীবনে প্রতিটি আনন্দের আভা অন্তর্গত দুঃখের ছায়া বহন করে, প্রতিটি সফলতা অন্তর্গত ব্যর্থতার গন্ধ। প্রতিটি সম্পর্কের ভেতর লুকিয়ে থাকে অস্থায়ীত্বের আভা, প্রতিটি স্মৃতির গভীরে লুকানো থাকে বিস্মৃতির বীজ। প্রতিটি পদক্ষেপ আমাদের একদিকে নিয়ে যায় অস্তিত্বের দিকে, আরেকদিকে নিয়ে যায় বিলুপ্তির দিকে।

আসলে জীবন, মৃত্যু, ভাবনা, ভবিষ্যত হলো এক জটিল জাল, যা আমার অস্তিত্বকে সংজ্ঞায়িত করে। আমি হয়তো অনন্ত শূন্যতায় একদিন পৃথিবী থেকে হারিয়ে যাব, কিন্তু আমার অস্তিত্বের প্রতিটি আভা, প্রতিটি ভাবনা, প্রতিটি কর্ম মহাবিশ্বের প্রতিটি স্পন্দনের সঙ্গে মিলিত হয়ে একটি চিরস্থায়ী ছাপ রেখে যাবে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top