ডোনাটেল্লো
ডোনাটেল্লো ছিলেন ইতালীয় রেনেসাঁ যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাস্কর।
তাঁর পূর্ণ নাম ছিল Donato di Niccolò di Betto Bardi।
জন্মগ্রহণ করেন ১৩৮৬ সালে, ইতালির ফ্লোরেন্স শহরে।
মৃত্যুবরণ করেন ১৪৬৬ সালে, ফ্লোরেন্সেই।
তিনি মূলত ভাস্কর্য শিল্পে (Sculpture) বিপ্লব ঘটান।
ডোনাটেল্লো ছিলেন রেনেসাঁ ভাস্কর্যের জনক বলে বিবেচিত।
তিনি ব্রোঞ্জ ও মার্বেল – দুই মাধ্যমেই অসাধারণ কাজ করেছেন।
তাঁর কাজগুলিতে দেখা যায় মানবদেহের বাস্তবতা ও আবেগের সূক্ষ্ম প্রকাশ।
তিনি প্রথম দিককার শিল্পীদের মধ্যে একজন যিনি মানবতাবাদী ভাবনা শিল্পে আনেন।
তাঁর শিল্প রেনেসাঁ যুগের ভিত্তি স্থাপন করে দেয়।
ডোনাটেল্লো ছিলেন ফিলিপ্পো ব্রুনেলেস্কি-এর ঘনিষ্ঠ বন্ধু।
তারা একসঙ্গে রোমে প্রাচীন ভাস্কর্য অধ্যয়ন করেছিলেন।
সেই গবেষণাই ডোনাটেল্লোর শিল্পচিন্তাকে নতুন দিশা দেয়।
তাঁর প্রথম গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল সেন্ট জর্জ (Saint George) ভাস্কর্য।
এটি ফ্লোরেন্সের Orsanmichele গির্জার জন্য তৈরি করা হয়।
“সেন্ট জর্জ” ভাস্কর্যে সাহস, দৃঢ়তা ও মানবিক ভাব একত্রে ফুটে ওঠে।
তাঁর বিখ্যাত ডেভিড (David) মূর্তিটি রেনেসাঁ যুগের প্রথম সম্পূর্ণ নগ্ন ভাস্কর্য।
এই “ডেভিড” ব্রোঞ্জে নির্মিত হয়েছিল।
এটি পশ্চিমা শিল্পে প্রথম স্বাধীন নগ্ন মূর্তি হিসেবে খ্যাত।
ডোনাটেল্লোর “ডেভিড” ভাস্কর্যে দেখা যায় যৌবন, সৌন্দর্য ও আত্মবিশ্বাস।
“ডেভিড” তৈরি করা হয়েছিল কসিমো দে মেডিচি-র জন্য।
এটি পরে Medici Palace-এ স্থাপন করা হয়।
ডোনাটেল্লো ছিলেন মেডিচি পরিবারের ঘনিষ্ঠ শিল্পী।
তিনি তাদের পৃষ্ঠপোষকতায় বহু কাজ করেন।
তাঁর আরেকটি বিখ্যাত কাজ Gattamelata নামে পরিচিত।
এটি ইতালির পদোয়া শহরে অবস্থিত এক অশ্বারোহী ভাস্কর্য (Equestrian Statue)।
এটি তৈরি হয় এরাসমো দা নার্নি (Erasmo da Narni)-র স্মরণে।
“Gattamelata” ইউরোপের প্রথম আধুনিক অশ্বারোহী ব্রোঞ্জ মূর্তি।
এটি প্রাচীন রোমান ভাস্কর্যের অনুপ্রেরণায় নির্মিত।
এই ভাস্কর্য রেনেসাঁর সামরিক বীরত্বের প্রতীক হিসেবে পরিচিত।
তাঁর প্রাথমিক প্রশিক্ষণ ছিল গোল্ডস্মিথ (স্বর্ণকার) হিসেবে।
তিনি লরেনজো ঘিবের্তি (Lorenzo Ghiberti)-র ওয়ার্কশপে কাজ শুরু করেন।
সেখানে তিনি ফ্লোরেন্সের Baptistery Doors তৈরিতে সহায়তা করেন।
১৪১৫-২০ সালের মধ্যে তিনি নিজস্ব শৈলী গঠন শুরু করেন।
তাঁর শৈলীতে দেখা যায় লিনিয়ার পার্সপেক্টিভ (Linear Perspective)-এর ব্যবহার।
এটি ছিল ত্রিমাত্রিক গভীরতা প্রকাশের বিপ্লবী কৌশল।
তাঁর এই শৈলী পরে মাসাচ্চিও ও লিওনার্দো দা ভিঞ্চির উপর প্রভাব ফেলে।
তিনি রেনেসাঁ যুগে বৈজ্ঞানিক শিল্পচিন্তা প্রতিষ্ঠা করেন।
তাঁর ভাস্কর্যে মানুষকে ঈশ্বরের সমান মর্যাদায় উপস্থাপন করা হয়েছে।
এটি ছিল মধ্যযুগের ধর্মীয় শিল্পচিন্তার বিপরীতে এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি।
তাঁর বিখ্যাত মার্বেল কাজগুলির মধ্যে অন্যতম St. Mark।
এই ভাস্কর্যে দেখা যায় বাস্তবধর্মী দেহগঠন ও মনস্তাত্ত্বিক শক্তি।
তিনি মানব মুখে আবেগ, চিন্তা ও চরিত্রের গভীরতা ফুটিয়ে তুলতেন।
তাঁর ভাস্কর্যে চুল, পোশাক ও দেহের প্রতিটি অংশে সূক্ষ্ম নিখুঁত কাজ দেখা যায়।
তিনি প্রথম শিল্পীদের মধ্যে ছিলেন যিনি “রিলিফ” ভাস্কর্যে পার্সপেক্টিভ প্রয়োগ করেন।
এই কৌশলটি তিনি নিজেই উদ্ভাবন করেন, যার নাম দেন “schiacciato relief”।
“Schiacciato” মানে খুব পাতলা, অল্প উঁচু – এটি গভীরতার ছায়া সৃষ্টি করত।
তাঁর Feast of Herod রিলিফ এই কৌশলের শ্রেষ্ঠ উদাহরণ।
এটি বর্তমানে সিয়েনা ক্যাথেড্রালের বাপ্তিস্মঘর (Baptistery)-এ সংরক্ষিত।
এই রিলিফে নাটকীয়তা ও বাস্তবতা একত্রে ফুটে ওঠে।
ডোনাটেল্লো ধর্মীয় থিম ছাড়াও পৌরাণিক বিষয়েও কাজ করেছেন।
তাঁর “Judith and Holofernes” একটি রাজনৈতিক ও নৈতিক প্রতীক।
এই ভাস্কর্যটি ফ্লোরেন্সে Medici Palace-এর বাগানে স্থাপন করা হয়েছিল।
এতে দেখা যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে সাহসী নারীর জয়।
এই কাজটি রেনেসাঁর গণতান্ত্রিক ভাবনার প্রতীক হিসেবে বিবেচিত।
তাঁর কাজগুলোতে নারীচরিত্রের দৃঢ়তা ও সৌন্দর্যও ফুটে ওঠে।
তিনি ভাস্কর্যে মানবচরিত্রের মনস্তত্ত্ব প্রকাশে অদ্বিতীয় ছিলেন।
তাঁর শিক্ষায় শিল্পীরা আবেগকে বাস্তব দেহভঙ্গিতে প্রকাশ করতে শেখে।
তাঁর তৈরি “Prophet Habakkuk” বা Zuccone ফিগার বিখ্যাত।
এই মূর্তির মুখমণ্ডল ছিল অদ্ভুত বাস্তবধর্মী ও গম্ভীর।
তাঁর কাজগুলিতে নাটকীয় আলোক ও ছায়ার ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়।
তিনি ছিলেন এক্সপ্রেশনিজমের পূর্বসূরি।
তাঁর কাজ পরবর্তী শতকের শিল্পীদের গভীরভাবে প্রভাবিত করে।
Michelangelo Buonarroti স্বীকার করেছিলেন যে তিনি ডোনাটেল্লোর প্রভাবে অনুপ্রাণিত হন।
মাইকেলেঞ্জেলোর “David” ভাস্কর্যটি ডোনাটেল্লোর “David”-এর উত্তরসূরি বলা যায়।
তিনি “মানব দেহের অনুপাত” নিয়ে গবেষণা করেন।
তিনি ভাস্কর্যে আন্দোলন (movement) প্রকাশের চেষ্টা করেন।
তাঁর কাজ ছিল স্থির নয়—এতে জীবনের স্পন্দন ছিল।
তাঁর মূর্তিতে দেহের ভারসাম্য (contrapposto pose) দেখা যায়।
এটি রেনেসাঁ ভাস্কর্যের অন্যতম মূল বৈশিষ্ট্য।
তিনি পিয়াজা, গির্জা, ও সরকারি ভবনের জন্য কাজ করেছেন।
তাঁর কাজ আজও ফ্লোরেন্স, পদোয়া ও রোমে দেখা যায়।
তিনি ধর্মীয় ভাস্কর্যের বাইরে সামাজিক বাস্তবতা এনেছিলেন।
তিনি সাধারণ মানুষকেও শিল্পের বিষয় হিসেবে গ্রহণ করেন।
তাঁর ভাস্কর্যে দেখা যায় বয়স্ক, দরিদ্র, বা ক্লান্ত মুখ—যা আগে দেখা যেত না।
এতে তিনি মানবতাবাদের প্রকৃত প্রতিনিধি হয়ে ওঠেন।
তাঁর শিল্পে নৈতিকতা, সৌন্দর্য ও বাস্তবতা মিলিত হয়।
তিনি শিল্পে ব্যক্তিত্বের স্বাতন্ত্র্য প্রকাশ করেন।
তিনি মধ্যযুগের প্রতীকী ভাস্কর্য থেকে বাস্তবতার যুগে রূপান্তর ঘটান।
তাঁর শৈলী রেনেসাঁর মানবকেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গিকে দৃঢ় করে।
১৪৩০–১৪৪০ দশকে তিনি পদোয়াতে বসবাস করেন।
সেখানে তিনি Sant’Antonio Basilica-র জন্য বহু কাজ করেন।
তাঁর “High Altar” এবং “Miracle of the Mule” রিলিফ অত্যন্ত বিখ্যাত।
পদোয়ার শিল্পীরা পরবর্তীতে তাঁর প্রভাবের অধীনে আসে।
পদোয়ার মূর্তি তৈরি করে তিনি ইউরোপে খ্যাতি পান।
জীবনের শেষ দিকে তিনি কিছু কাজ অসমাপ্ত রেখেছিলেন।
তাঁর মৃত্যু হয় ১৪৬৬ সালের ১৩ ডিসেম্বর।
মৃত্যুর পর তাঁকে ফ্লোরেন্সের Basilica di San Lorenzo-তে সমাহিত করা হয়।
আজও তাঁর কবরের পাশে তাঁর কাজের অনুলিপি রাখা আছে।
ফ্লোরেন্সে তাঁর নামে রাস্তা ও মূর্তি স্থাপন করা হয়েছে।
তাঁর শিল্পচিন্তা ইউরোপে বাস্তববাদী রেনেসাঁর সূচনা ঘটায়।
তিনি “মানুষই ঈশ্বরের সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ প্রতিচ্ছবি”—এই ভাবনা প্রচার করেন।
তাঁর তৈরি ভাস্কর্যগুলো আজও Uffizi Gallery, Bargello Museum ও Padua Basilica-তে সংরক্ষিত।
তাঁর শিল্প ছিল প্রযুক্তি ও আত্মার সমন্বয়।
তিনি শুধুমাত্র ভাস্কর ছিলেন না, ছিলেন দার্শনিক শিল্পচিন্তাবিদ।
ডোনাটেল্লো শিল্পের স্বাধীনতা ও ব্যক্তিসত্তার প্রতীক।
তাঁর সৃষ্ট কাজ আজও শিল্পশিক্ষায় মডেল হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
তিনি প্রমাণ করেছিলেন যে ভাস্কর্য শুধু ধর্মীয় উপাসনার উপকরণ নয়, বরং মানব জীবনের প্রতিচ্ছবি।
আধুনিক ইউরোপীয় ভাস্কর্যের প্রতিটি অধ্যায়ে তাঁর নাম উল্লেখযোগ্য।
ডোনাটেল্লোকে বলা যায় — “রেনেসাঁ ভাস্কর্যের পিতা”, যিনি বাস্তবতাকে সৌন্দর্যের ভাষায় রূপ দিয়েছিলেন।








