দিয়েগো ভেলাসকেজ
দিয়েগো ভেলাসকেজ জন্মগ্রহণ করেন ৬ জুন ১৫৯৯ সালে, সেভিল, স্পেনে।
তাঁর পূর্ণ নাম ছিল Diego Rodríguez de Silva y Velázquez।
তিনি স্প্যানিশ ব্যারোক যুগের সর্বশ্রেষ্ঠ চিত্রশিল্পীদের একজন।
ভেলাসকেজ রাজা ফিলিপ চতুর্থ (Philip IV)-এর রাজকীয় দরবারের প্রধান চিত্রশিল্পী ছিলেন।
তাঁর কাজের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো বাস্তবতা, আলোকছায়া এবং মানবিকতার গভীরতা।
তিনি প্রতিকৃতি চিত্রণে অতুলনীয় ছিলেন।
তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত চিত্রকর্ম হলো “Las Meninas” (লাস মেনিনাস)।
“Las Meninas” ১৬৫৬ সালে আঁকা হয়েছিল।
এই চিত্রটি ইউরোপীয় শিল্পের ইতিহাসে এক অনন্য উদাহরণ।
“Las Meninas”-এ রাজপরিবার, রাজকন্যা মার্গারেট থেরেসা এবং শিল্পী নিজেকে দেখা যায়।
ভেলাসকেজ সেভিলে বড় হয়েছেন, যেখানে তিনি শৈশবে চিত্রাঙ্কনের প্রশিক্ষণ নেন।
তাঁর প্রথম শিক্ষক ছিলেন Francisco de Herrera the Elder।
পরবর্তীতে তিনি প্রশিক্ষণ নেন Francisco Pacheco-এর কাছে, যিনি তাঁর শ্বশুরও হন।
ভেলাসকেজ ১৬১৮ সালে প্যাচেকোর কন্যা Juana Pacheco-কে বিয়ে করেন।
তাঁর দুটি কন্যা সন্তান ছিল।
১৭ বছর বয়সে তিনি নিজস্ব স্টুডিও খুলেছিলেন।
তাঁর প্রাথমিক চিত্রগুলিতে দৈনন্দিন জীবন ও শ্রমজীবী মানুষের বাস্তব চিত্র ফুটে ওঠে।
এই ধরনের কাজগুলোকে বলা হয় “bodegones” (রান্নাঘর দৃশ্য বা সাধারণ জীবনের দৃশ্য)।
তাঁর প্রথম দিকের বিখ্যাত কাজগুলির মধ্যে একটি হলো “Old Woman Frying Eggs” (১৬১৮)।
এই কাজটি বাস্তব আলো ও বস্তুর নির্ভুল উপস্থাপনের জন্য প্রশংসিত।
১৬২৩ সালে তিনি মাদ্রিদে যান।
সেখানেই তিনি রাজা ফিলিপ চতুর্থের চিত্রশিল্পী হিসেবে নিযুক্ত হন।
তিনি দ্রুতই রাজপরিবারের আস্থা অর্জন করেন।
রাজা তাঁকে খুব ভালোবাসতেন ও তাঁর প্রতিভাকে শ্রদ্ধা করতেন।
তিনি প্রায় ৩০ বছর রাজা ফিলিপ চতুর্থের দরবারে কাজ করেন।
তাঁর দরবারের অনেক সদস্য ও রাজপরিবারের সদস্যদের প্রতিকৃতি তিনি আঁকেন।
ভেলাসকেজের “Portrait of Philip IV” সিরিজ বিশেষভাবে বিখ্যাত।
তাঁর চিত্রে রাজকীয় আভিজাত্য ও মানবিক কোমলতা মিলেমিশে থাকে।
তিনি শুধুমাত্র বাহ্যিক রূপ নয়, চরিত্রের গভীরতাও ফুটিয়ে তুলতেন।
তাঁর আলোক ব্যবহার অত্যন্ত দক্ষ ও প্রাকৃতিক।
ভেলাসকেজ ১৬২৯ সালে ইতালি সফরে যান।
তিনি রোম, ভেনিস, ফ্লোরেন্সসহ বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণ করেন।
ইতালির রেনেসাঁ শিল্পীদের প্রভাব তিনি গভীরভাবে গ্রহণ করেন।
বিশেষ করে টিশিয়ান, রাফায়েল ও মাইকেলএঞ্জেলো তাঁকে অনুপ্রাণিত করেন।
তিনি নিজে টিশিয়ানের কিছু চিত্র কিনে আনেন।
তাঁর ইতালি সফরের পর কাজের গুণগত মান আরও উন্নত হয়।
তিনি প্রাচীন রোমান ভাস্কর্য ও চিত্রকলার অধ্যয়ন করেন।
স্পেনে ফিরে এসে তিনি নতুন রঙ ও আলো ব্যবহারের কৌশল যুক্ত করেন।
তাঁর শৈলীতে তখন রোমান বাস্তবতা ও স্প্যানিশ গাম্ভীর্য একসাথে দেখা যায়।
১৬৪৯ সালে তিনি দ্বিতীয়বার ইতালি যান।
দ্বিতীয় সফরে তিনি পোপ ইনোসেন্ট একাদশের (Innocent X) প্রতিকৃতি আঁকেন।
এই প্রতিকৃতি “Portrait of Pope Innocent X” এখন রোমের ডোরিয়া পামফিলি গ্যালারিতে সংরক্ষিত।
এটি বিশ্বের অন্যতম সেরা প্রতিকৃতি বলে গণ্য করা হয়।
পোপ নিজেও ছবিটি দেখে অবাক হয়ে বলেছিলেন: “Troppo vero!” (অতিরিক্ত বাস্তব)।
এই চিত্রটি পরবর্তীতে ফ্রান্সিস বেকনের মতো আধুনিক শিল্পীদেরও প্রভাবিত করে।
ভেলাসকেজ নিজেকে কখনও প্রচারের কেন্দ্র বানাননি।
তিনি শান্ত, সংযত ও মেধাবী ব্যক্তি ছিলেন।
তাঁর সহকর্মীরা তাঁকে গভীর শ্রদ্ধা করতেন।
তিনি রাজদরবারে শুধু চিত্রশিল্পী নন, রাজকার্য পরিচালনার দায়িত্বেও নিযুক্ত ছিলেন।
তাঁকে রাজা চেম্বারলেন (Aposentador Mayor del Palacio) পদে উন্নীত করেন।
এই পদে তিনি রাজপ্রাসাদের অনুষ্ঠান ও অতিথিদের দেখভাল করতেন।
তাঁর প্রশাসনিক দায়িত্ব সত্ত্বেও তিনি চিত্রাঙ্কন চালিয়ে যান।
তাঁর চিত্রে রঙের সংযম ও সূক্ষ্মতা বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়।
তিনি খুব কম রঙ ব্যবহার করে গভীর প্রভাব সৃষ্টি করতেন।
তাঁর কাজে কালো, বাদামি ও ধূসর রঙের ব্যবহার অসাধারণ ভারসাম্যপূর্ণ।
তিনি প্রতিটি চরিত্রকে বাস্তবভাবে জীবন্ত করে তুলতেন।
তিনি নিম্নবর্গের মানুষ, ভাঁড় ও বামনদেরও গভীর মানবিকতায় আঁকতেন।
যেমন, “Portrait of Sebastian de Morra” এবং “Las Meninas”-এর dwarfs।
এইসব প্রতিকৃতিতে অপমান বা ব্যঙ্গ নয়, বরং সহানুভূতি প্রকাশ পায়।
তাঁর মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি তাঁকে আলাদা করে তোলে।
ভেলাসকেজ আলোকের দিক ও প্রতিফলন নিখুঁতভাবে ধরতেন।
তাঁর কাজ প্রায়ই পরবর্তী ইমপ্রেশনিস্টদের পূর্বসূরি হিসেবে বিবেচিত হয়।
বিশেষ করে এদুয়ার মানে (Édouard Manet) তাঁকে “painters’ painter” বলেছেন।
মানে তাঁর কাজকে আধুনিক শিল্পের সূচনা হিসেবে দেখেছিলেন।
ভেলাসকেজ কখনও অতিরিক্ত অলংকারপ্রিয় ছিলেন না।
তাঁর শৈলীতে সৌন্দর্য আসে সরলতা ও বাস্তবতার মাধ্যমে।
তিনি ১৬৫০-এর দশকে রাজপরিবারের বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য প্রতিকৃতি আঁকেন।
এর মধ্যে রাজকন্যা Infanta Margarita Teresa-এর প্রতিকৃতি বিশেষভাবে বিখ্যাত।
রাজকন্যার প্রতিকৃতিগুলো আজ ইউরোপের বিভিন্ন জাদুঘরে সংরক্ষিত।
“Infanta Margarita in a Blue Dress” তাঁর অন্যতম সেরা কাজ।
ভেলাসকেজের প্রভাব পরবর্তী শতাব্দীগুলোতে ব্যাপকভাবে দেখা যায়।
তাঁর আলো, রঙ ও গঠনশৈলী ইমপ্রেশনিস্টদের প্রেরণা দেয়।
পিকাসো ও দালিও তাঁর কাজ দ্বারা অনুপ্রাণিত হন।
পিকাসো নিজের একটি সিরিজে “Las Meninas”-এর পুনর্ব্যাখ্যা করেন।
ভেলাসকেজের রচনায় স্প্যানিশ বাস্তববাদ চূড়ান্ত শিখরে পৌঁছায়।
তিনি শিল্পে মর্যাদা ও বুদ্ধিবৃত্তিক উচ্চতা এনে দেন।
তাঁর সময়ে চিত্রশিল্পীরা সাধারণত কারিগর বলে গণ্য হতেন।
কিন্তু ভেলাসকেজ রাজদরবারে শিল্পী হিসেবে রাজপদ লাভ করেন।
১৬৫৯ সালে তিনি Order of Santiago-এর নাইট পদ পান।
এটি ছিল স্পেনের সর্বোচ্চ সম্মানগুলোর একটি।
রাজা নিজেই তাঁর জন্য এই পদ লাভের ব্যবস্থা করেন।
ভেলাসকেজের “Las Meninas”-এ তাঁর পোশাকে এই নাইটের চিহ্ন দেখা যায়।
অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন, পরে ছবিটিতে চিহ্নটি যোগ করা হয়েছিল।
তাঁর শেষ দিকের চিত্রে রঙ আরও নরম ও ঢিলা হয়ে যায়।
এগুলো আধুনিক শিল্পের ঢঙের পূর্বাভাস দেয়।
তাঁর শেষ কাজগুলোর মধ্যে “The Spinners” (Las Hilanderas) বিখ্যাত।
এটি প্রাচীন কাহিনি ও শ্রমজীবী নারীর কাজকে একসাথে দেখায়।
এতে আলোর স্তর ও গতির উপস্থাপন অসাধারণ।
এই কাজটি তাঁর দক্ষতার চূড়ান্ত নিদর্শন।
তিনি ৬ আগস্ট ১৬৬০ সালে মাদ্রিদে মৃত্যুবরণ করেন।
মৃত্যুর কিছুদিন পর তাঁর স্ত্রীও মারা যান।
তাঁকে মাদ্রিদের সান হুয়ান ব্যাপ্টিস্টা গির্জায় সমাহিত করা হয়।
দুর্ভাগ্যবশত, গির্জাটি পরবর্তীতে ধ্বংস হয়ে যায়, ফলে তাঁর কবর চিহ্নিত নেই।
তাঁর শিল্পজীবন ছিল তুলনামূলকভাবে সংক্ষিপ্ত, কিন্তু অসাধারণ প্রভাববিস্তারকারী।
ভেলাসকেজ প্রায় ১২০টি কাজ রেখে গেছেন।
এগুলো বর্তমানে মাদ্রিদের Prado Museum, লন্ডনের National Gallery, এবং প্যারিসের Louvre-এ সংরক্ষিত।
“Las Meninas” বর্তমানে প্রাদো মিউজিয়ামের প্রধান আকর্ষণ।
তাঁর কাজের প্রতি বিশ্বজুড়ে শিল্পী ও গবেষকরা গভীর শ্রদ্ধা পোষণ করেন।
তিনি স্প্যানিশ স্বর্ণযুগের (Spanish Golden Age) সর্বশ্রেষ্ঠ প্রতিনিধি।
দিয়েগো ভেলাসকেজ আজও মানব বাস্তবতা, আলো এবং সৌন্দর্যের অমর চিত্রশিল্পী হিসেবে সমাদৃত।













