জোসেফ ম্যালর্ড উইলিয়াম টার্নার
জোসেফ ম্যালর্ড উইলিয়াম টার্নার ছিলেন একজন ইংরেজ চিত্রশিল্পী।
তাঁর জন্ম ২৩ এপ্রিল, ১৭৭৫ সালে লন্ডনের কোভেন্ট গার্ডেনে।
তাঁর মৃত্যুর তারিখ ১৯ ডিসেম্বর, ১৮৫১।
তিনি মূলত আলো, রঙ ও প্রাকৃতিক দৃশ্যের প্রকাশে বিখ্যাত ছিলেন।
টার্নারকে প্রায়ই “Light-এর Painter” বলা হয়।
তিনি রোমান্টিক যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিল্পী।
তাঁর কাজগুলো প্রাকৃতিক শক্তি ও আবহের নাটকীয় প্রকাশ ঘটায়।
তাঁর পূর্ণ নাম — Joseph Mallord William Turner।
তাঁর পিতা উইলিয়াম টার্নার ছিলেন একজন নাপিত ও উইগ নির্মাতা।
তাঁর মা মেরি মার্শাল মানসিক সমস্যায় ভুগতেন।
টার্নারের আঁকার প্রতি ঝোঁক শৈশবেই প্রকাশ পায়।
তিনি দশ বছর বয়সে প্রথম আঁকার প্রশিক্ষণ নেন।
তাঁর প্রথম চিত্র প্রদর্শিত হয়েছিল মাত্র ১৫ বছর বয়সে।
১৭৮৯ সালে তিনি রয়্যাল একাডেমি অব আর্টসে ভর্তি হন।
তিনি সেখানে জোশুয়া রেনল্ডসের তত্ত্বাবধানে শিক্ষা পান।
প্রথমদিকে টার্নার স্থাপত্যচিত্র ও জলরঙে কাজ করতেন।
১৭৯৬ সালে তাঁর প্রথম তেলচিত্র প্রদর্শিত হয় — Fishermen at Sea।
এই চিত্রটি তাঁকে রাতারাতি খ্যাতি এনে দেয়।
তাঁর কাজগুলোতে প্রকৃতির অপরিসীম শক্তি ও আলো-ছায়ার খেলা প্রধান উপাদান ছিল।
টার্নার প্রকৃতিকে শুধু দৃশ্য নয়, অনুভূতি হিসেবে প্রকাশ করেছেন।
তিনি ছিলেন একান্তই নিজস্ব ধরণের শিল্পী।
সমুদ্রঝড়, সূর্যাস্ত, অগ্নিকাণ্ড ইত্যাদি তাঁর প্রিয় বিষয় ছিল।
তাঁর চিত্রগুলো প্রায়ই রোমান্টিক তীব্রতা ও বিমূর্ততার মিশ্রণ।
তিনি জলরঙ ব্যবহারে বিপ্লব ঘটিয়েছিলেন।
টার্নারের জলরঙের কাজগুলো আজও অনন্য।
তিনি ইউরোপ ভ্রমণ করেছিলেন অনুপ্রেরণার জন্য।
ইতালি, ফ্রান্স, সুইজারল্যান্ড ইত্যাদি দেশে তিনি স্কেচ করেছেন।
তাঁর ভ্রমণচিত্রে আলোক ও কুয়াশার চমৎকার ব্যবহার দেখা যায়।
তিনি রোম ও ভেনিসে বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত হন।
তাঁর ভেনিস-চিত্রগুলো আলো ও প্রতিফলনের এক বিস্ময়কর উদাহরণ।
টার্নারের রং ব্যবহারে একধরনের আধ্যাত্মিক আবহ ছিল।
তিনি প্রাকৃতিক দৃশ্যের মধ্যে মানব অস্তিত্বের ক্ষুদ্রতা দেখাতে ভালোবাসতেন।
তাঁর চিত্রে প্রায়ই মানুষ ছোট, প্রায় অদৃশ্য থাকে।
তিনি বিশ্বাস করতেন যে প্রকৃতি নিজেই সর্বশক্তিমান শিল্পী।
তাঁর আঁকার কৌশল ছিল দ্রুত ও প্রবল আবেগময়।
টার্নারের তুলির আঁচড় ছিল ঘূর্ণি ও আলোছায়ার মিশ্রণ।
অনেকেই বলেন, টার্নার আধুনিক বিমূর্ত শিল্পের পূর্বসূরি।
তিনি শিল্পের মাধ্যমে প্রকৃতির গতিশীল শক্তিকে ধরতে চেয়েছেন।
তাঁর কাজ শিল্পজগতে আলো, বায়ু ও গতি প্রকাশে নতুন ভাষা দিয়েছিল।
তিনি রঙের মাধ্যমে অনুভূতি প্রকাশে বিশেষ পারদর্শী ছিলেন।
টার্নারের প্রখ্যাত চিত্রগুলির মধ্যে অন্যতম — The Fighting Temeraire।
এই চিত্রে দেখা যায় পুরনো যুদ্ধজাহাজকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে একটি স্টিমবোট।
এটি শিল্পবিপ্লবের আগমনের প্রতীকী রূপ বলে মনে করা হয়।
এই চিত্রটি ব্রিটিশ জনগণের মধ্যে অত্যন্ত জনপ্রিয়।
২০০৫ সালে এটি ব্রিটেনের “জাতীয় প্রিয় চিত্রকর্ম” নির্বাচিত হয়।
আরেকটি বিখ্যাত চিত্র — Rain, Steam and Speed – The Great Western Railway।
এই চিত্রে টার্নার প্রযুক্তির গতি ও প্রকৃতির শক্তিকে একসাথে ফুটিয়েছেন।
The Slave Ship (1840) তাঁর অন্যতম রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ চিত্র।
এতে দেখা যায় দাসদের সমুদ্রে ফেলে দেওয়ার ভয়াবহ দৃশ্য।
এই চিত্র মানবতার বিরুদ্ধে নিষ্ঠুরতার প্রতীক।
টার্নার ব্যক্তিগত জীবনে ছিলেন খুব একাকী।
তিনি কখনও বিয়ে করেননি।
তাঁর দুটি কন্যা ছিল, যদিও তিনি তাঁদের খুব বেশি স্বীকৃতি দেননি।
তিনি অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল ছিলেন, কিন্তু জীবনযাপন ছিল অগোছালো।
তাঁর আচরণ অনেক সময় অদ্ভুত ও নির্লিপ্ত ছিল।
তিনি নিজের স্টুডিওতে কাজ করতে পছন্দ করতেন, জনসমক্ষে কম যেতেন।
তিনি নিজের চিত্রের মূল্য সম্পর্কে সচেতন ছিলেন।
টার্নার রাজকীয় কমিশনও পেয়েছিলেন।
তিনি রয়্যাল একাডেমির পূর্ণ সদস্য হন ১৮০২ সালে।
পরবর্তীতে তিনি সেখানে অধ্যাপক হিসেবে কাজ করেন।
তিনি “Perspective”-এর উপর বক্তৃতাও দিয়েছিলেন।
তাঁর বক্তৃতাগুলো দুরূহ ও জটিল হিসেবে বিবেচিত হয়।
টার্নারের কাজ প্রায়ই সমসাময়িক সমালোচকদের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করত।
কেউ কেউ তাঁকে প্রতিভাবান বলতেন, কেউ উন্মাদ।
তাঁর শেষ জীবনে দৃষ্টিশক্তি দুর্বল হয়ে গিয়েছিল।
তবুও তিনি আঁকা বন্ধ করেননি।
মৃত্যুর আগে তিনি টেমস নদীর ধারে শান্ত জীবন যাপন করেন।
মৃত্যুর আগে তাঁর শেষ কথা ছিল — “The Sun is God.”
তিনি ১৮৫১ সালে মারা যান চেলসিতে।
তাঁকে সেন্ট পলস ক্যাথেড্রালে সমাধিস্থ করা হয়।
মৃত্যুর পর তাঁর চিত্রসম্ভার ব্রিটিশ সরকারকে দান করা হয়।
আজ সেই চিত্রগুলির বড় অংশ লন্ডনের Tate Britain-এ সংরক্ষিত।
টার্নারকে ইংল্যান্ডের জাতীয় সম্পদ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
২০শ শতকে তাঁর গুরুত্ব আরও বেড়ে যায়।
ইমপ্রেশনিস্ট শিল্পীরা তাঁকে অনুপ্রেরণা হিসেবে দেখেছেন।
বিশেষ করে ক্লদ মোনে তাঁর আলোকপ্রয়োগের প্রশংসা করেছেন।
টার্নারের রঙের ধোঁয়াটে ব্যবহার ইমপ্রেশনিজমের ভিত্তি স্থাপন করে।
আধুনিক শিল্প সমালোচকরা তাঁকে “প্রথম আধুনিক চিত্রশিল্পী” বলেন।
তিনি শুধুমাত্র প্রাকৃতিক দৃশ্য নয়, অনুভূতির প্রকাশ আঁকতেন।
তাঁর রং ব্যবহারের সাহস ও স্বাধীনতা ছিল যুগান্তকারী।
তিনি প্রায় ২০০০ টিরও বেশি জলরঙের কাজ করেছেন।
তেলচিত্রের সংখ্যা প্রায় ৩০০ এরও বেশি।
তাঁর রেখে যাওয়া স্কেচবুকের সংখ্যা ৩০০ টিরও বেশি।
এই স্কেচবুকগুলো টেট মিউজিয়ামে রক্ষিত আছে।
তিনি নিজেকে প্রায়ই “Water Turner” বলে মজা করতেন।
তাঁর স্টাইল ধীরে ধীরে ক্লাসিক বাস্তবতা থেকে রোমান্টিক বিমূর্ততায় পৌঁছায়।
অনেক শিল্পী তাঁর আলোক ব্যবহারের কৌশল অনুসরণ করেছেন।
টার্নার আধুনিক দৃশ্যচিত্রের পথপ্রদর্শক।
তিনি কেবল একজন চিত্রকরই নন, বরং একজন দার্শনিকও ছিলেন।
তাঁর চিত্রে নৈতিক ও আধ্যাত্মিক প্রতীকবোধ গভীরভাবে জড়িত।
তাঁর জীবনের উপর ভিত্তি করে ২০১৪ সালে Mr. Turner নামক চলচ্চিত্র তৈরি হয়।
এই চলচ্চিত্রে টিমোথি স্পল টার্নারের ভূমিকায় অভিনয় করেন।
ছবিটি আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত হয়।
টার্নারের নামেই “Turner Prize” নামক মর্যাদাপূর্ণ শিল্প পুরস্কারের নামকরণ।
এটি ১৯৮৪ সালে চালু হয় ব্রিটিশ আধুনিক শিল্পীদের সম্মান জানাতে।
টার্নারের রঙ, আলো ও বায়ুর চিত্রভাষা আজও শিল্পে প্রভাবশালী।
তিনি প্রকৃতির সৌন্দর্য ও ভয় একসাথে দেখাতে সক্ষম হয়েছিলেন।
টার্নারের শিল্পে মানুষের সীমাবদ্ধতা ও প্রকৃতির অসীমতা মিলেমিশে যায়।
তাঁর উত্তরাধিকার আজও সমকালীন শিল্পে অনুপ্রেরণার উৎস।
জে.এম.ডব্লিউ. টার্নার — আলো, রঙ ও অনুভূতির এক চিরন্তন জাদুকর।










