বেঞ্জামিন ফ্র্যাঙ্কলিন (১৭০৬–১৭৯০) ছিলেন এমন এক ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব, যাঁর জীবন যেন বহুরঙা এক ক্যানভাসে আঁকা—বিজ্ঞান, রাজনীতি, সাংবাদিকতা, কূটনীতি, দার্শনিক চিন্তা, সমাজসংস্কার, উদ্ভাবন ও মানবকল্যাণের প্রতিটি ক্ষেত্রেই তিনি অমর রেখাপাত করেছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা পিতাদের একজন হিসেবে তাঁর নাম ইতিহাসে সুপ্রতিষ্ঠিত হলেও, তাঁর পরিচয় কেবল রাষ্ট্রনির্মাতা হিসেবে সীমাবদ্ধ নয়; তিনি ছিলেন জাগরণের দূত, জ্ঞানসন্ধানী এক অনির্বাণ মন, আত্মশিক্ষার প্রতীক ও বিশ্বাসযোগ্য মানু্ষত্বের উজ্জ্বল উদাহরণ।
শৈশব ও কৈশোর: দারিদ্র্য থেকে প্রজ্ঞার পথে
১৭০৬ সালের ১৭ জানুয়ারি, বোস্টনের মিলকরী পরিবারের চৌদ্দ সন্তানের অন্যতম হিসেবে জন্ম নেন বেঞ্জামিন। পিতার মোম ও সাবান তৈরির ছোট ব্যবসা পরিবারকে সচ্ছল করে তুলতে পারেনি, বরং অভাবই ছিল নিত্যসঙ্গী। সে কারণে তাঁর আনুষ্ঠানিক শিক্ষাজীবন ছিল মাত্র দুই বছরের। কিন্তু এই সীমাবদ্ধতা তাঁর কৌতূহলী মনকে স্তব্ধ করতে পারে নি। বই ছিল তাঁর প্রথম প্রেম ও সারাজীবনের অঙ্গীকার। তিনি বই ধার করে পড়তেন, যেখানেই যেতেন জ্ঞানের আলো তিনি নিজেই খুঁজে নিতেন।
১২ বছর বয়সে তাঁকে ভাই জেমসের প্রিন্টিং দোকানে শিক্ষানবিশ হিসেবে কাজ করতে দেওয়া হয়। এখানেই শুরু হয় তাঁর মুদ্রণশিল্প, সাংবাদিকতা ও লেখালেখির সঙ্গে গভীর সম্পর্ক। ভাইয়ের পত্রিকা The New-England Courant-এ তিনি “মিসেস সাইলেন্স ডুগুড” নাম ছদ্মবেশে ব্যঙ্গ-রসাত্মক প্রবন্ধ লেখেন, যা পাঠকদের মাঝে জনপ্রিয়তা পায়—কিন্তু ভাই জেমস জানতেন না যে লেখক তাঁরই কনিষ্ঠ ভাই।
এই প্রাথমিক অভিজ্ঞতাগুলোই তাঁকে লেখক, সম্পাদক ও চিন্তাশীল নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলে।
ফিলাডেলফিয়া: জীবনের নতুন অধ্যায়
১৭ বছর বয়সে ফ্র্যাঙ্কলিন বোস্টন ছেড়ে ফিলাডেলফিয়ায় পাড়ি জমান। হাতে ছিল খুব সামান্য অর্থ। কিন্তু মনে ছিল অদম্য উদ্যম ও কাজ শেখার অপরিসীম ইচ্ছা।
ফিলাডেলফিয়ায় মুদ্রণশিল্পে কাজ খুঁজে পেয়ে তিনি ধীরে ধীরে নিজের দক্ষতায় সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। জনসাধারণের সমস্যাবলি, ব্যবসায়ের নীতি, সমাজের দুর্বলতা ও উন্নয়নের পথ নিয়ে তাঁর লেখাগুলি পাঠকদের অনুপ্রাণিত করত। ১৭৩০ সালের দিকে তিনি নিজস্ব প্রিন্টিং প্রেস স্থাপন করেন এবং ১৭৩১ সালে প্রতিষ্ঠা করেন “Library Company of Philadelphia”—আমেরিকার প্রথম সার্বজনীন গ্রন্থাগার। এটি ছিল জ্ঞানের আলো সকলের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়ার তাঁর আজীবন বিশ্বাসের বাস্তব প্রয়াস।
এ ছাড়া তিনি প্রতিষ্ঠা করেন—
আমেরিকার প্রথম স্বেচ্ছাসেবী অগ্নিনির্বাপক দল
প্রথম বৈজ্ঞানিক সমাজ (American Philosophical Society)
প্রথম সমবায়ী হাসপাতাল
এগুলো স্পষ্ট করে, তিনি কেবল চিন্তাবিদ নন, তিনি বাস্তববাদী নির্মাতা।
Poor Richard’s Almanack: প্রজ্ঞার বাগান
১৭৩২ থেকে ১৭৫৮ পর্যন্ত তিনি Poor Richard’s Almanack নামে বার্ষিক পঞ্জিকা প্রকাশ করেন, যা তাঁর জনপ্রিয়তার নতুন উচ্চতা নির্ধারণ করে। এই পঞ্জিকার পাতায় পাতায় তিনি ছড়িয়ে দেন—
জীবনের জ্ঞান
সাফল্যের নীতি
পরিশ্রম ও মিতব্যয়ের শিক্ষা
হাস্যরস মেশানো উপদেশ
বিখ্যাত কিছু উক্তি:
“Time is money.”
“Early to bed and early to rise makes a man healthy, wealthy, and wise.”
“Lost time is never found again.”
এগুলো কেবল বাণী নয়; এগুলো ছিল তাঁর অভিজ্ঞতা ও বিশ্বাসের সারাংশ, যা আজও জীবনের বাস্তবতায় প্রাসঙ্গিক।
বিজ্ঞানী ফ্র্যাঙ্কলিন: ঝড়ের আকাশে বুদ্ধির পাখা
যে নাম শুনলে বজ্রপাতের কথা মনে পড়ে, সে নাম হলো বেঞ্জামিন ফ্র্যাঙ্কলিন। তিনি ছিলেন প্রকৃতির ভিতর লুকিয়ে থাকা রহস্য উন্মোচনের পথিক।
বৈদ্যুতিক গবেষণা
তিনি প্রথম প্রমাণ করেন বজ্রপাত আসলে বিদ্যুতেরই এক রূপ
নিজের বিখ্যাত ঘুড়ি-পরীক্ষা (১৭৫২) দিয়ে ঝড়ের মধ্যে ঘুড়ির ডোরায় সংযুক্ত চাবির মাধ্যমে বিদ্যুৎ সংগ্রহ করেন
আবিষ্কার করেন Lightning Rod, যা পরবর্তীতে অসংখ্য ভবনকে অগ্নিকাণ্ড থেকে রক্ষা করে
“Positive” ও “Negative” চার্জ শব্দদুটি তিনি প্রথম ব্যবহার করেন
বিদ্যুতের প্রবাহ ও প্রক্রিয়া নিয়ে তাঁর গবেষণা ইউরোপে বৈপ্লবিক আলোড়ন তোলে
বিদ্যুৎ নিয়ে তাঁর প্রবন্ধ তাঁকে বিশ্বব্যাপী সম্মান এনে দেয়—লন্ডন, প্যারিসসহ বহু বৈজ্ঞানিক প্রতিষ্ঠানের সদস্য হন তিনি।
জনজীবন ও সমাজসংস্কার: জনগণের সেবায় নিবেদিত মন
ফ্র্যাঙ্কলিন মনে করতেন, ভালো সমাজ গড়ে তোলার দায়িত্ব নাগরিকদেরই। সেই কারণেই তিনি আমেরিকায় বিভিন্ন উন্নয়নমূলক উদ্যোগের নেতৃত্ব দেন।
শিক্ষা
প্রতিষ্ঠা করেন University of Pennsylvania—নতুন দৃষ্টিভঙ্গির উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান
শিক্ষায় ব্যবহারিক দক্ষতার প্রতি তাঁর জোর ছিল সমাজে আধুনিক শিক্ষাচেতনা এনে দেয়
স্বাস্থ্য ও সুরক্ষা
প্রথম স্বেচ্ছাসেবী ফায়ার ব্রিগেড
হাসপাতাল ও বীমা ব্যবস্থার ধারণা ছড়িয়ে দেওয়া
শহরের স্যানিটেশন ব্যবস্থা উন্নয়ন
সামাজিক মূল্যবোধ
তিনি মানুষকে স্বনির্ভরতা, পরিশ্রম, সততা ও নাগরিক দায়িত্ববোধের শিক্ষা দিয়েছিলেন। তাঁর চিন্তায় ছিল নিবিড় মানবতাবোধ।
আমেরিকান রাজনীতি ও স্বাধীনতা আন্দোলনে অবদান
বেঞ্জামিন ফ্র্যাঙ্কলিন ছিলেন আমেরিকার স্বাধীনতা আন্দোলনের এক কৌশলগত পথনির্দেশক। তিনি বুঝতেন, ব্রিটিশ করনীতি ও দমননীতির বিরুদ্ধে একটি ঐক্যবদ্ধ রাজনৈতিক কাঠামো প্রয়োজন।
Stamp Act বিরোধী আন্দোলন
১৭৬৫ সালের “Stamp Act” ছিল ব্রিটিশ সরকারের অযৌক্তিক করনীতি, যার বিরুদ্ধে আমেরিকানরা ক্ষুব্ধ ছিল। ফ্র্যাঙ্কলিন এই আইনের বিরোধিতায় লন্ডনে গিয়ে যুক্তিপূর্ণ বক্তৃতা দেন এবং ব্রিটিশ পার্লামেন্টে কর আইনের ক্ষতিকর দিক তুলে ধরেন। তাঁর অবস্থান আমেরিকার পক্ষে জনমত গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
Declaration of Independence
১৭৭৬ সালে স্বাধীনতার ঘোষণা-পত্র রচনায় ফ্র্যাঙ্কলিন ছিলেন কমিটির অন্যতম সদস্য। যদিও থমাস জেফারসন প্রধান খসড়া প্রস্তুত করেন, ফ্র্যাঙ্কলিন সেটিকে নিখুঁত করতে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সংশোধন করেন।
বিদেশনীতি ও কূটনীতি
ফ্র্যাঙ্কলিন ছিলেন একজন দক্ষ কূটনীতিক। স্বাধীনতার সংগ্রামে ফ্রান্সের সমর্থন আদায় ছিল আমেরিকার বিজয়ের নির্ণায়ক মুহূর্ত। ফ্র্যাঙ্কলিন প্যারিসে অবস্থান করে ফরাসি রাজসভাকে আমেরিকার পক্ষে সামরিক ও আর্থিক সমর্থন দিতে রাজি করান। তাঁর মেধা, সৌজন্য ও রসবোধ ফরাসিদের মন জয় করে নেয়।
১৭৮৩ সালে প্যারিস চুক্তি স্বাক্ষরেও তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন, যার মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে আমেরিকার স্বাধীনতা স্বীকৃত হয়।
সংবিধান রচনা ও গণতন্ত্রের ভিত্তি নির্মাণ
১৭৮৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান সম্মেলনে বয়সের ভারে ন্যুব্জ হলেও ফ্র্যাঙ্কলিনের বুদ্ধি তখনও দীপ্তিমান। তিনি সংবিধান তৈরির বিরোধ-সংঘাত শান্ত করতে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে অসাধারণ ভূমিকা পালন করেন।
তিনি বলেছিলেন—
“একটি আদর্শ সরকার কখনো সৃষ্টি হয় না, কিন্তু আমরা যদি সর্বোত্তম সম্ভাব্য সমাধানে একমত হতে পারি, সেটিই আমাদের সাফল্য।”
আজকের মার্কিন গণতন্ত্রের ভিত নির্মাণে তাঁর পরামর্শ ও প্রজ্ঞা মূখ্য ভূমিকা পালন করেছে।
ফ্র্যাঙ্কলিনের দার্শনিক চিন্তা: মানবতার জ্যোৎস্না
ফ্র্যাঙ্কলিন জীবনকে দেখতেন স্বনির্মাণের অনন্ত যাত্রা হিসেবে। তিনি ত্রুটি সংশোধনের জন্য নিজের ১৩টি নৈতিক গুণাবলির তালিকা তৈরি করেছিলেন—যা তিনি “Art of Virtue” হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
এই গুণাবলির মধ্যে ছিল—
সংযম
নীরবতা
শৃঙ্খলা
দৃঢ়সংকল্প
মিতব্যয়
নিষ্ঠা
ন্যায়
পরিচ্ছন্নতা
সংযমিতা
বিনয়
এই নীতি অনুসরণ করতে গিয়ে তিনি প্রতিদিন নিজের কার্যকলাপ বিশ্লেষণ করতেন। আজকের সেল্ফ-হেল্প দর্শনের অনেকেই ফ্র্যাঙ্কলিনকে তাদের অন্যতম পথিকৃৎ মনে করেন।
বৈচিত্র্যময় উদ্ভাবন
ফ্র্যাঙ্কলিনের উদ্ভাবনী মন সর্বদা তৎপর ছিল সমাজে বাস্তব উন্নতি আনার জন্য। তাঁর কিছু উল্লেখযোগ্য উদ্ভাবন—
Lightning rod
Bifocal lenses (দুটি ভিন্ন পাওয়ার যুক্ত চশমা)
Franklin stove (উন্নত তাপীয় চুলা)
Armonica (একটি সঙ্গীতযন্ত্র)
Flexible urinary catheter
এই উদ্ভাবনগুলো কেবল প্রযুক্তিগত উন্নয়ন এনে দেয়নি, মানুষের জীবনকে সহজ করেছে।
আন্তর্জাতিক খ্যাতি ও সাংস্কৃতিক প্রভাব
বেঞ্জামিন ফ্র্যাঙ্কলিন ছিলেন এমন এক ব্যক্তি, যার উপস্থিতি ইউরোপ ও আমেরিকার বুদ্ধিজীবী সমাজে সমানভাবে আলোচিত। তিনি ছিলেন যুগের সেরা মনগুলোর সঙ্গে আলোচনাসহযোগী—ভলতেয়ার, হিউম, প্রিস্টলি প্রমুখ তাঁকে সম্মানের চোখে দেখতেন।
ফ্র্যাঙ্কলিনের মুক্তচিন্তা, বৈজ্ঞানিক দৃষ্টি ও মানবিকতা তাঁকে Enlightenment যুগের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিনিধি করে তোলে।
জীবনের শেষ অধ্যায়
৮৪ বছর বয়সে ১৭৯০ সালের ১৭ এপ্রিল ফ্র্যাঙ্কলিনের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে আমেরিকার ইতিহাসে এক মহাজাগরণের অধ্যায় সমাপ্ত হয়। তাঁর মৃত্যুতে ফ্রান্স পার্লামেন্ট পুরো একদিন বন্ধ রাখা হয়—এ ছিল তাঁর প্রতি আন্তর্জাতিক শ্রদ্ধার প্রমাণ।
উইল-এ তিনি সম্পদ রেখে যান সাধারণ মানুষের কল্যাণে। তাঁর শেষ বাক্যগুলোতেও ছিল মানবপ্রেমের আলো।
উত্তরাধিকার: চিরায়ত প্রেরণা
বেঞ্জামিন ফ্র্যাঙ্কলিনের নাম আজও আমেরিকান মূল্যবোধের প্রতীক। তাঁর জীবন পাঁচটি প্রধান স্তম্ভে অমর হয়ে রয়েছে—
স্বশিক্ষা ও জ্ঞানপিপাসা
ব্যক্তিগত উন্নয়ন ও নৈতিকতা
বিজ্ঞান ও উদ্ভাবন
গণতন্ত্র ও মানবাধিকার
সামাজিক সংস্কার ও নাগরিক দায়িত্ববোধ
তাঁর জীবন শেখায়—অভাব কোনও বাধা নয়, যদি মানুষের মনে থাকে আলো খোঁজার তৃষ্ণা। সীমিত শিক্ষা সত্ত্বেও তিনি নিজেদের প্রতিভা ও অধ্যবসায়ের মাধ্যমে বিশ্ব ইতিহাসে এক অবিনশ্বর নাম হয়ে উঠেছেন।
বেঞ্জামিন ফ্র্যাঙ্কলিন ছিলেন বহুমাত্রিক এক ব্যক্তিত্ব—যাঁর মধ্যে একইসঙ্গে আমরা দেখি বিজ্ঞানী, দার্শনিক, উদ্যোক্তা, সাংবাদিক, কূটনীতিক, সমাজসংস্কারক ও রাষ্ট্রনির্মাতা। তাঁর জীবন যেন মানবসম্ভাবনার এক উজ্জ্বল প্রদীপ, যা আজও যুগে যুগে মানুষকে অনুপ্রাণিত করে।
তিনি ছিলেন এমন এক মানুষ, যিনি নিজেকে জিজ্ঞাসা করতেন—“আমি আজ কী শিখলাম?”
আর সমাজকে জিজ্ঞাসা করতেন—“আমি আজ সমাজের জন্য কী করলাম?”
এটাই তাঁকে ইতিহাসের পৃষ্ঠায় নেতার চেয়েও বেশি কিছু—এক আদর্শ মানব হিসেবে তুলে ধরে।


















