সাহিত্য এমন এক অগ্নি-শিখা, যা প্রায়ই সভ্যতার ধুলোমলিন প্রান্ত থেকে উঠে এসে মানবজীবনের আলো আঁধারিকে দৃশ্যমান করে তোলে। উনিশ শতকের শেষভাগে আমেরিকার পশ্চিম সীমান্ত—পাহাড়, অরণ্য, সোনার খনি আর রুক্ষ প্রকৃতির মধ্যে—একজন লেখক সেই আলোকে নতুন রূপ দিলেন। তিনি ব্রেট হার্ট। অসংখ্য কাহিনি, ছোটগল্প, কবিতা ও প্রাবন্ধিক রচনার মাধ্যমে তিনি ক্যালিফোর্নিয়ার “গোল্ড রাশ”–যুগকে শুধু ইতিহাসের অধ্যায়ে নয়, মানবিক বোধের ভিতরেও স্থায়ী করে দিলেন।
হার্ট ছিলেন গল্পের এক কারিগর; তাঁর চোখে প্রকৃতি ছিল রঙিন নাট্যমঞ্চ এবং মানুষ ছিল তার অভিনয়শিল্পী—ভালোমানুষ, ঠগ, কৌতুকময়, করুণ, নায়ক, খল—সব একসঙ্গে। তাঁর সাহিত্য পাঠ করলে মনে হয়, কুয়াশার মধ্যে ঢেকে থাকা পাহাড়ের ঢালে আগুন জ্বেলে বসে আছি, চারপাশে গান, হাসি, সংঘর্ষ এবং অদ্ভুত মানবিকতা।
১. শৈশব ও গঠনকাল
ব্রেট হার্টের জন্ম ১৮৩৬ সালে নিউ ইয়র্কে। তাঁর শৈশব ছিল কিছুটা ছায়া-আলো মেশানো। পিতা ছিলেন শিক্ষক, কিন্তু তাঁর মৃত্যুর পর পরিবারের আর্থিক অবস্থা নড়বড়ে হয়ে যায়। এই অনিশ্চয়তা তাঁকে অল্প বয়সেই জীবন ও মানুষের বিচিত্র দিকগুলো পর্যবেক্ষণ করতে শিখিয়েছিল।
কৈশোরে তিনি নানান ধরনের কাজ করেছেন—ছাত্রবৃত্তি থেকে শুরু করে দপ্তরকর্মী, শিক্ষকতা, এমনকি সাংবাদিকতার প্রাথমিক অভিজ্ঞতাও। এই বহুমাত্রিক অভিজ্ঞতা ভবিষ্যতের লেখককে নানা মানুষের ভিড়ে মানস-ভূগোল তৈরির ক্ষমতা দিয়েছিল। তিনি ছিলেন প্রকৃতি-নিবেদিত এক ঘূর্ণিঝড়ময় সংগ্রাহক—মানুষ, ভাষা, আচরণ, পরিস্থিতি—সবকিছু সংগ্রহ করতেন ভবিষ্যতের রচনার কাণ্ডারী হিসেবে।
১৮৫৪ সালে তিনি ক্যালিফোর্নিয়ায় যান; এর পর থেকেই তাঁর সাহিত্যিক নক্ষত্র উদয়ের পথ তৈরি হয়।
২. ক্যালিফোর্নিয়া: সোনার খনির দেশ, গল্পের উর্বর ভূমি
যে ভূমিতে তিনি পৌঁছেছিলেন, সেটি তখন আমেরিকার পশ্চিম সীমান্তের এক উন্মাদ সময়। “গোল্ড রাশ”—সোনার খোঁজে মানুষের ঢল। খনি-শ্রমিক, ভবঘুরে, জুয়াড়ি, ডাকাত, ভবিষ্যত-নির্মাণের স্বপ্নদ্রষ্টা—সবাই এক মঞ্চে। এই অনিয়মিত, উত্তেজনাপূর্ণ পরিবেশের মধ্যেই ব্রেট হার্ট নিজের লেখক-পরিচয় খুঁজে পান।
এই পশ্চিম সীমান্তে তিনি ছিলেন পোস্টমাস্টার, শিক্ষক, সংবাদপত্র সম্পাদক—নানা ভূমিকা। এই কর্মজীবনের আড়ালে তিনি দেখেছেন মানুষের দুর্লঙ্ঘ্য আত্মসংগ্রাম, লোভ, উদারতা, অভিমান, গভীর মানবিকতা—যেগুলো পরবর্তীতে তাঁর রচনার প্রাণ হয়ে উঠেছে।
তাঁর ক্যালিফোর্নিয়া—শুধুমাত্র ভৌগোলিক অবস্থান নয়; এটি ছিল চরিত্র সৃষ্টি ও গল্প বলার এক উর্বর ভুবন। বলা হয়ে থাকে, ব্রেট হার্ট আমেরিকার পশ্চিম সীমান্তকে যেমনভাবে গল্পে তুলে ধরেছেন, তার আগে কেউ সেই নান্দনিকতা ও মানবিক গভীরতার সঙ্গে এই অঞ্চলকে স্পর্শ করেননি।
৩. সাহিত্যজীবনের সূচনা: শব্দের আলোয় প্রথম দীপ্তি
হার্টের সাহিত্যিক কর্মজীবনের প্রথম উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ ছিল The Californian এবং The Overland Monthly–তে লেখালেখি। এখানেই প্রথম প্রকাশিত হয় তাঁর বিখ্যাত ছোটগল্প “The Luck of Roaring Camp” (১৮৬৮)। গল্পটি প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে পাঠক ও সমালোচকের দৃষ্টি তাঁর দিকে নিবদ্ধ হয়।
গল্পে জন্ম নেয় এক অনাথ শিশু—যার লালন-পালনে উঠে আসে খনি-শ্রমিকদের কঠোরতা, কোমলতা এবং অভিযাত্রিক মানবিকতা। এই গল্প পাঠকসমাজকে অবাক করে; কারণ হার্ট ফুটিয়ে তুলেছিলেন এমন এক হৃদয় ও মানবিকতা, যা খাড়া পাহাড়ের ধূলোমাটির নিচেও প্রবলভাবে বিদ্যমান।
এরপর একে একে তিনি লিখলেন—
“The Outcasts of Poker Flat”
“Miggles”
“Tennessee’s Partner”
“Plain Language from Truthful James” (যা পরে “The Heathen Chinee” নামে বিখ্যাত হয়)
প্রতিটি রচনা যেন পশ্চিমের অগণিত চরিত্রের ভাণ্ডার থেকে তুলে আনা এক অনন্য মানব-নাট্য।
৪. লেখনশৈলী: ব্রেট হার্টের শব্দ-জগৎ
হৃদয়ের অলিগলি থেকে উঠে আসা চরিত্র, সংক্ষিপ্ত অথচ ভারী সংলাপ, প্রকৃতি ও মানুষের বর্ণনার ছন্দ, হাস্যরসের ভেতরে লুকানো ব্যথা—সব মিলিয়ে ব্রেট হার্ট ছিলেন ছোটগল্পের অনন্য শিল্পী।
তাঁর লেখনশৈলীর কিছু প্রধান বৈশিষ্ট্যঃ
ক. গভীর মানবিকতা
হার্টের গল্পে অপরাধীও ভীষণ মানবিক, খলনায়কও কোনো না কোনো মুহূর্তে হৃদয়ের আলো ছড়ায়। তিনি দেখান—মানুষ কখনো একরঙা নয়; মানবচরিত্র বহুস্তরীয়।
খ. তীক্ষ্ণ ব্যঙ্গ ও কৌতুক
হার্টের হাস্যরস কখনো চঞ্চল, কখনো দংশনকারী। বিশেষ করে “The Heathen Chinee”–এ তিনি ব্যঙ্গ করেছেন শ্বেতাঙ্গ সমাজের পূর্বাগ্রহকে।
গ. সংলাপের নাটকীয়তা
হার্টের চরিত্ররা যেন জীবন্ত। তাদের কথোপকথন সরাসরি চোখের সামনে অভিনয়ের মতো ফুটে ওঠে।
ঘ. সীমান্তজীবনের বহুমাত্রিক ছবি
পাহাড়, নদী, খনি, ট্যাভার্ন, কার্ড টেবিল, ধুলোবালির পথে ছুটে চলা ঘোড়া—সবকিছুই তাঁর গল্পে জীবন্ত।
ঙ. ট্র্যাজেডি এবং আলো
অবসাদ আর আশা তাঁর লেখার দুই সঙ্গী; একটি অন্যটিকে ছাপিয়ে যায় না। পাঠক সবসময় অনুভব করেন—অন্ধকারেও আলো আছে।
হার্টের গল্পে প্রকৃতি, মানুষ, হাসি, ব্যর্থতা—সব প্রতিটি চরিত্রের মতোই স্বয়ংসম্পূর্ণ। মূল্যবোধ ও মানবিকতা তাঁর গল্পের ভেতর দিয়ে অনর্গল প্রবাহিত হয়।
৫. ব্রেট হার্টের বিখ্যাত রচনাবলি
নীচে তাঁর কিছু উল্লেখযোগ্য বই, গল্পসংগ্রহ ও কাব্যগ্রন্থ উল্লেখ করা হলো:
১. The Luck of Roaring Camp and Other Sketches (১৮৭০)
তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত গল্পসংগ্রহ। ক্যালিফোর্নিয়ার খনিকেন্দ্রিক মানবজীবনের রূপরেখা এখানে সবচেয়ে তীক্ষ্ণভাবে ফুটে ওঠে।
২. The Outcasts of Poker Flat
মর্মস্পর্শী গল্প—একদল বহিষ্কৃত মানুষের যাত্রাপথ ও করুণ পরিণতি। মানবিক দুর্বলতা এবং অদম্য জেদের গল্প।
৩. Tennessee’s Partner
বন্ধুত্ব, আনুগত্য এবং অপরাধবোধের অনন্য গল্প।
৪. Gabriel Conroy (উপন্যাস)
যদিও উপন্যাসটি তাঁর ছোটগল্পের মতো জনপ্রিয়তা পায়নি, তবু এতে পশ্চিম-জীবনের বহুস্তরীয় চিত্র রয়েছে।
৫. Mrs. Skaggs’s Husbands and Other Sketches
রসাত্মক অথচ মানবিক গল্পসমূহের সংগ্রহ।
৬. Poems (বিভিন্ন সংকলন)
তিনি কবিতা লিখেছেন; বিশেষ করে ব্যঙ্গাত্মক কবিতা তাঁর জনপ্রিয়তার একটি দিক।
৭. The Heathen Chinee
চীনা অভিবাসী শ্রমিকদের নিয়ে ব্যঙ্গাত্মক কবিতা; এটি তাঁর রচনাকর্মে বিতর্ক ও জনপ্রিয়তা দুটোই এনে দেয়।
তাঁর রচনার ভুবন এত সমৃদ্ধ যে পাঠককে আকর্ষণ করে রাখার ক্ষমতা আজও অটুট।
৬. জনপ্রিয়তা, সাফল্য ও সমালোচনা
লেখনীর প্রথম দিকেই হার্ট ব্যাপক সাফল্য লাভ করেন। এমনকি মার্ক টোয়েনের সঙ্গেও তাঁর ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে—যদিও ভবিষ্যতে দুজনের মধ্যে কিছু দূরত্বও সৃষ্টি হয়।
সাফল্যের কারণ
তাঁর গল্প ছিল সহজ, মর্মস্পর্শী
পাঠক প্রথমবার দেখল আমেরিকার পশ্চিম সীমান্তের জীবন্ত ছবি
তাঁর চরিত্রগণ ছিল মনুষ্যত্বের উজ্জ্বল ও অন্ধকার দুই দিকের সমন্বয়
সমালোচনা
কিছু সমালোচক মনে করতেন—হার্ট কখনো কখনো অতিরিক্ত রোমান্টিকতা দেখিয়েছেন। আবার কেউ কেউ বলেছেন—তিনি পশ্চিমকে খানিকটা রোমাঞ্চকর আলোয় দেখিয়েছেন, বাস্তবতার কঠোর দিকটিকে কিছুটা নরম করে তুলেছেন।
তবে এসব সমালোচনা সত্ত্বেও সাহিত্য-ঐতিহ্যে তাঁর স্থান অনন্য।
৭. আন্তর্জাতিক জীবন: ইউরোপে শেষ অধ্যায়
জীবনের শেষ দিকে ব্রেট হার্ট কনসাল হিসেবে ইউরোপে যান। জার্মানি, স্কটল্যান্ড, ফ্রান্স—অনেক জায়গায় তিনি কাজ করেছেন। যদিও তাঁর জনপ্রিয়তা কিছুটা কমেছিল, তিনি লেখালেখি থামাননি।
১৮৯০–এর দশকে ইউরোপেই তিনি বহুলাংশে বসবাস করেন। তাঁর বিদেশ-জীবনে গল্পের রস কিছুটা বদলে যায়—সীমান্তজীবনের বদলে আসতে থাকে ইউরোপীয় পরিবেশ, কূটনীতি, ও সামাজিক পর্যবেক্ষণের ছাপ। তবুও তাঁর শব্দচিহ্নে পশ্চিম সীমান্ত সর্বদা ছিল।
১৯০২ সালে ব্রেট হার্ট মৃত্যুবরণ করেন—ফ্রান্সের ক্যাম্ব্রে শহরে। কিন্তু তাঁর গল্পের পথে ধ্বনিত থাকে মানুষের চিরন্তন যাত্রার নড়াচড়া।
৮. ব্রেট হার্ট ও আমেরিকান সাহিত্যে তাঁর প্রভাব
হার্টের সাহিত্য আমেরিকান কথাসাহিত্যে এক নতুন ধারার জন্ম দেয়। বিশেষত ওয়েস্টার্ন ফিকশন, রিজিওনালিজম, রিয়ালিজম—সব ধারাতেই তিনি নিজস্ব আলো ছড়িয়েছেন।
তাঁর প্রভাবের কয়েকটি দিকঃ
ক. ‘ওয়েস্টার্ন’ সাহিত্যের ভিত্তি স্থাপন
হার্টকে বলা হয়—ওয়েস্টার্ন সাহিত্যধারার অগ্রদূত। পরবর্তী প্রায় সব লেখক তাঁর পথ অনুসরণ করেছেন।
খ. ছোটগল্পের গঠন ও কৌশল
সংক্ষিপ্ত অথচ আঘাতমূলক গল্পের কৌশল তিনি ব্যাপক জনপ্রিয় করে তুলেন।
গ. আঞ্চলিক বাস্তবতা
চরিত্র ও ভাষায় আঞ্চলিকতার ব্যবহার তিনি সাহিত্যে মর্যাদা দিয়েছেন।
ঘ. মানবিকতার ব্যাপ্তি
সমাজের উপেক্ষিত চরিত্র—জুয়াড়ি, শ্রমিক, ডাকাত, পরিত্যক্ত নারী—সবাইকে তিনি মানবিক মর্যাদা দিয়েছেন।
ঙ. মার্ক টোয়েনসহ অনেক লেখককে প্রভাবিত করা
তিনি মার্ক টোয়েনের সঙ্গে প্রথমে কাজ করেন এবং উভয়ের লেখনশৈলীতে একে অপরের প্রভাব দেখা যায়।
৯. ব্রেট হার্টের সাহিত্য: আজকের পাঠকের কাছে কী মূল্য?
হার্টের রচনা আজও পাঠককে আকৃষ্ট করে। কারণঃ
তাঁর গল্প মানবিক
ভাষা সংক্ষিপ্ত কিন্তু গভীর
নাটকীয়তা আছে, আবার বাস্তবতাও থেকে যায়
চরিত্রগুলো বহুমাত্রিক
আজকের পাঠক যখন তাঁর গল্প পড়ে, তখন শুধু সময়-ভ্রমণই করেন না; বরং উপলব্ধি করেন—প্রকৃতি ও মানুষ, লোভ ও স্নেহ, অপরাধ ও দয়া—সবই মানবজীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ।
ব্রেট হার্ট ছিলেন মানুষের গল্পকার—রুক্ষ পাহাড়, খনিকেন্দ্রিক বসতি, ধুলোময় পথ, গান, হাসি, বেদনা, করতলধ্বনি—সব মিলিয়ে তাঁর গল্প ছিল জীবনের বাদ্যযন্ত্রে বাজানো এক অনন্য সুর।
তিনি ছায়া-আলোতে ভরা আমেরিকার পশ্চিম সীমান্তকে এমনভাবে তুলে ধরেছেন, যেন পাঠকের চোখের সামনে এক বিশাল নাট্যমঞ্চ। তাঁর চরিত্ররা কখনো পরাজিত, কখনো শুভ্র, কখনো দুরন্ত—কিন্তু সবসময় মানবিক।
সাহিত্যের দীর্ঘ যাত্রাপথে ব্রেট হার্ট এক উজ্জ্বল নাম—যার রচনায় মানুষের ভালো-মন্দ, আশাভঙ্গ ও আশার জোয়ার একই সঙ্গে প্রবাহিত। আমেরিকান ছোটগল্পে তাঁর অবদান আজও অক্ষুণ্ণ, এবং পৃথিবীর পাঠকদের কাছে তিনি আজও রোমাঞ্চকর এক গল্পকার, যিনি শব্দের ভিতর দিয়ে পাহাড়-অরণ্যের বাতাস বয়ে আনেন।
১. The Luck of Roaring Camp (১৮৬৮)
ধরন: গল্পসংগ্রহ / পশ্চিমাঞ্চলীয় কাহিনি
এই বইয়ের শিরোনাম গল্পটি হার্টকে রাতারাতি বিখ্যাত করে তোলে। “রোরিং ক্যাম্প”—একটি খনিশহর, যেখানে কঠোর, রুক্ষ, প্রায় আইনহীন পুরুষরা থাকে। একদিন একটি অকালপ্রসূত বাচ্চা জন্মালে—যাকে তারা “Luck”—অর্থাৎ ভাগ্য বলে ডাকতে শুরু করে—পুরো শিবিরের জীবন পাল্টে যায়।
গল্পটি দেখায়, মানুষের নৈতিকতার বীজ কখনও কখনও কঠিন পরিবেশেও জন্ম নেয়। শ্রমিকদের রুক্ষ দুনিয়ায় শিশুটির আগমনে যে মানবিকতার ঢেউ ওঠে, সেটি বইয়ের প্রধান আবেগ।
সংগ্রহের অন্য গল্পগুলোতেও খনিকর্মী, জুয়াড়ি, পথিক ও পরিত্যক্ত মানুষের এক বর্ণময় সমাজ ধরা পড়েছে।
২. The Outcasts of Poker Flat (১৮৬৯)
ধরন: গল্পসংগ্রহ / নৈতিক সংকট ও মানবিকতা
একটি ছোট শহর “Poker Flat” সমাজকে পরিষ্কার করতে গিয়ে কয়েকজন “অপাংক্তেয়” মানুষকে তাড়িয়ে দেয়—এক জুয়াড়ি, এক নারী, এক চোর। তুষারঝড়ে আটকে পড়ে তারা সকলেই একদল যাত্রীসহ।
এ গল্পে সমাজের বিচার-বিভাজনের সঙ্গে মানুষের আসল চরিত্রের সংঘর্ষ উঠে আসে। বাহ্যিকভাবে দোষী বলে পরিচিত লোকেরাই শেষ পর্যন্ত সবচেয়ে মানবিক, সাহসী ও আত্মত্যাগী হয়ে ওঠে।
বইয়ের অন্যান্য গল্পেও সমাজের মূল্যবোধের অন্ধতা ও মানবপ্রেমের আলো একসঙ্গে জ্বলজ্বলে।
৩. Tennessee’s Partner (১৮৬৯)
ধরন: বন্ধুত্বের গল্প
হার্টের সবচেয়ে হৃদয়স্পর্শী গল্পগুলোর একটি। তেনেসি নামের বেপরোয়া, সমস্যাসংকুল এক মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে থাকে তার নিঃশব্দ, নির্ভরযোগ্য সঙ্গী। তেনেসির অপরাধের বিচারকালে এবং মৃত্যুর পরেও তার সঙ্গী অবিচল থাকে।
এই গল্প আমেরিকান সাহিত্যে বন্ধুত্বকে নতুন মানে দিয়েছে—নিঃশর্ত, অলঙ্কারহীন, মানবিক বন্ধন।
সংগ্রহে খনিকর্মী জীবনের রুক্ষতা ও হৃদয়ের কোমলতা পাশাপাশি এগিয়েছে।
৪. The Heathen Chinee (১৮৭০)
ধরন: ব্যঙ্গাত্মক কবিতা/গল্প
চীনা অভিবাসীদের উপরে বর্ণবাদী আচরণের সময়ে লেখা এক চমৎকার ব্যঙ্গকাজ। গল্পে Ah Sin নামে এক চীনা মানুষকে ধরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে শ্বেতাঙ্গরা, কিন্তু শেষ পর্যন্ত শ্বেতাঙ্গদেরই প্রতারণা ধরা পড়ে।
হার্ট আসলে সমাজের ভণ্ডামি তুলে ধরেছেন—যেখানে “সভ্যরা” নিজেরাই অনৈতিক কাজে লিপ্ত, আর যাকে সন্দেহ করে তাকে সত্যিকারে দোষী বানিয়ে ফেলা হয়।
গল্পটি ব্যাপক জনপ্রিয় হয় এবং আমেরিকার বর্ণবৈষম্য নিয়ে প্রবল আলোচনা তৈরি করে।
৫. Poems (১৮৭১)
ধরন: কবিতাসংগ্রহ
হার্টের কবিতা তাঁর গদ্যের মতোই প্রাণময়। পশ্চিমাঞ্চলের প্রকৃতি, খনিশিবিরের জীবন, মানুষের হাসি-দুঃখ—সবকিছু ছন্দে বুনেছিলেন। তাঁর কবিতায় নাটকীয়তা, ব্যঙ্গ, বিষাদ ও নরম আবেগ সবই একত্রে মিশে থাকে।
এ বই তাঁকে শুধু গল্পকার নয়, এক পরিপূর্ণ সাহিত্যস্রষ্টা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে।
৬. Gabriel Conroy (১৮৭৬)
ধরন: উপন্যাস (হার্টের একমাত্র পূর্ণদৈর্ঘ্য উপন্যাস)
এটি হার্টের উচ্চাকাঙ্ক্ষী কাজ। ক্যালিফোর্নিয়ার গোল্ড রাশ–এর পটভূমিতে লেখা এই উপন্যাসে রয়েছে—
এক যুবক Gabriel
জমি ও সম্পত্তিকে কেন্দ্র করে বিরোধ
প্রেম, রহস্য, রাজনৈতিক উত্তেজনা
মানবিকতা বনাম লোভ
উপন্যাসটি পাঠকদের তখনকার সমাজের বহুমাত্রিক ছবি দেখায়—শোষণ, উচ্চাকাঙ্ক্ষা, বন্যপ্রকৃতি এবং মানুষের সংগ্রাম। এটি হার্টের গভীরতম সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করে।
৭. Mrs. Skaggs’s Husbands (১৮৭২)
ধরন: ব্যঙ্গ ও পরিবারকেন্দ্রিক ছোটগল্প
পশ্চিমাঞ্চলের বিবাহ, সম্পর্ক, গুজব ও সমাজের মানসিকতার ওপর মজাদার ব্যঙ্গ।
Mrs. Skaggs নামের এক নারীর একাধিক স্বামী নিয়ে নানা গুজব ছড়ায়। কিন্তু ধীরে ধীরে সমাজের নিজস্ব ভুল ধারণাই উন্মোচিত হয়।
গল্পটি মানবসম্পর্ক, নারীর অবস্থান এবং ছোটশহরের “বলা না বলা” নিয়েই নির্মিত।
৮. Tales of the Argonauts (১৮৭৫)
ধরন: গল্পসংগ্রহ
এই বইয়ে ক্যালিফোর্নিয়ার গোল্ড রাশ অভিযাত্রীদের (“Argonauts”) জীবন তুলে ধরা হয়েছে।
মানুষের অভিযানপ্রবণতা, জীবনের ঝুঁকি, সম্পদের লোভ এবং মানবিক সম্পর্ক—সব একসঙ্গে বোনা।
হার্ট এখানে কয়েকটি ভিন্ন ধারার গল্প লিখেছেন—কখনও প্রেম, কখনও দুঃখ, কখনও অপরাধ, কখনও সমাজের ব্যঙ্গ।
৯. Thankful Blossom (১৮৭৬)
ধরন: ঐতিহাসিক রোমান্স
আমেরিকান স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়কার পটভূমিতে লেখা।
Thankful Blossom নামের এক তরুণীকে কেন্দ্র করে গল্প।
দেশপ্রেম, প্রেমের সম্পর্ক, রাজনৈতিক সংঘাত—সব মিশে আছে গল্পে। হার্ট এখানে তাঁর গল্পকারসুলভ রসিকতা ও নাটকীয়তা বজায় রেখেছেন।
১০. The Story of a Mine (১৮৭৮)
ধরন: উপন্যাস/দীর্ঘগল্প
ক্যালিফোর্নিয়ায় সোনা খোঁজার জটিল প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং খনিশিল্পের নৈতিক টানাপোড়েন এই বইয়ের কেন্দ্রবিন্দু।
একটি খনি আবিষ্কারের খবর ছড়িয়ে পড়তেই নানা পক্ষ—জমিদার, কর্মী, ব্যবসায়ী—একসঙ্গে ভিড় করে, এবং গল্পে ধীরে ধীরে উন্মোচিত হয়—
লোভ
প্রতারণা
মানবিক বিশ্বাসঘাতকতা
হার্ট দেখিয়েছেন, সম্পদের লোভ সমাজকে কীভাবে বিষিয়ে তোলে।
১১. Tales of Trail and Town (১৮৯৩)
ধরন: পরিণত বয়সের গল্পসংগ্রহ
এখানে হার্ট মানুষের অন্তর্জগৎকে আরও পরিশীলিতভাবে ধরেছেন। ছোট শহরের মানুষ, পথিক, ব্যবসায়ী, সাধারণ গৃহস্থ—সবাই গল্পে উপস্থিত।
উত্তর ক্যালিফোর্নিয়া, সান ফ্রান্সিসকো, এবং গ্রামাঞ্চলের জীবনচিত্র খুব জ্যান্ত।
হার্টের ভাষার রসবোধ এখানে আরও মোলায়েম।
১২. Trent’s Trust and Other Stories (১৯০3)
ধরন: শেষ দিকের গল্পসংগ্রহ
সততা, বিশ্বাস, প্রতারণা, এবং মানবিকতার নানা রঙ এই গল্পগুলোতে উঠে আসে।
হার্ট বার্ধক্যে পৌঁছে আরও শান্ত, সূক্ষ্ম বুনটের গল্প লিখেছিলেন।
“Trent’s Trust”–এ দেখা যায় মানববিশ্বাসের ভঙ্গুরতা এবং মানুষের অদ্ভুত মনোজগত।




















