নিউ ইংল্যান্ডের সপ্তদশ শতাব্দীর ইতিহাস যখন চোখের সামনে ভেসে ওঠে, তখন যুদ্ধ, উপনিবেশ স্থাপনা, জাতিগত সংঘর্ষ ও সাংস্কৃতিক টানাপোড়েন মিলে এক জটিল দৃশ্যপট তৈরি হয়। এই দৃশ্যপটের মধ্যেই বেঞ্জামিন চার্চ এমন এক চরিত্র, যিনি একদিকে যুদ্ধকৌশলের প্রবর্তক, অন্যদিকে প্রথম আমেরিকান “রেঞ্জার” বাহিনীর জনক। তাঁর জীবন ছিল দুঃসাহসিক অভিযানে ভরপুর; কখনো তিনি উপনিবেশবাদীদের নিরাপত্তার প্রতীক, আবার কখনো তার নাম উচ্চারণ করা হয় আদিবাসী জনগোষ্ঠীর দৃষ্টিতে এক নির্মম প্রতিপক্ষ হিসেবে। ইতিহাস তাঁকে সহজ করে বিচার করেনি। বরং তাঁর পরিচয় গড়ে উঠেছে নানা স্তর ও প্রশ্নচিহ্নের সমন্বয়ে।
বেঞ্জামিন চার্চের পরিবারিক পটভূমি, কিং ফিলিপের যুদ্ধে তাঁর ভূমিকা, যুদ্ধকৌশলের বিবর্তনে তাঁর অসামান্য অবদান, পরবর্তী ফরাসি-ইন্ডিয়ান সংঘাতে তাঁর উপস্থিতি এবং তাঁর অস্তিত্বকে ঘিরে বিরোধপূর্ণ পর্যালোচনা। তাঁর জীবনের প্রতিটি বাঁকে একদিকে রয়েছে সাহসের গল্প, অন্যদিকে রক্তাক্ত রাজনীতির ছায়া—এই দ্বৈত রূপই তাঁকে নিউ ইংল্যান্ডের ইতিহাসে এক অনন্য অবস্থানে পৌঁছে দিয়েছে।
১. জন্ম, পটভূমি ও সামাজিক পরিবেশ
বেঞ্জামিন চার্চের জন্ম ১৬৩৯ সালে প্লিমাথ কলোনির অন্তর্ভুক্ত ডক্সবারিতে। তাঁর পরিবার ছিল ইংরেজ পুরিটান অভিবাসীদের মধ্যে অন্যতম, যারা নতুন পৃথিবীতে নিজেদের জন্য নতুন পরিচয় রচনার চেষ্টা করছিল। এটি এমন এক সময় যখন উপনিবেশবাসীরা নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে সংগ্রামরত—প্রকৃতির কঠোরতা, খাদ্যাভাব, স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সঙ্গে সম্পর্ক, এবং ইংল্যান্ডের সঙ্গে দূরবর্তী রাজনৈতিক যোগ এসবই তখনকার দিনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ।
চার্চের পিতা রিচার্ড চার্চ ছিলেন একজন কাঠামিস্ত্রি, যিনি উপনিবেশের নির্মাণকাজে যুক্ত ছিলেন। ছোটবেলায় বেঞ্জামিন প্রকৃতির মধ্যে বড় হয়েছেন—সমুদ্রতীর, বনবাদাড়, অনাবাদি জমি—সবকিছুই তাঁকে অল্প বয়সেই অভিযাত্রী মনমানসিকতায় গড়ে তুলেছিল। তিনি বড় হতে হতে বুঝেছিলেন যে এই ভূমিতে বেঁচে থাকতে হলে শুধু কৃষিকাজ বা ধর্মীয় চর্চাই নয়, দরকার কৌশল, বুদ্ধিমত্তা এবং কখনো কখনো অস্ত্রধারণ।
নিউ ইংল্যান্ডে তখন আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সঙ্গে সম্পর্ক খুবই সূক্ষ্ম অবস্থায়। বাণিজ্য, জমি, এবং উপনিবেশ সম্প্রসারণ নিয়ে উত্তেজনা বাড়ছিল। এই সময় বেঞ্জামিন চার্চ ধীরে ধীরে উপনিবেশিক সমাজে নিজেকে প্রস্তুত করছিলেন—যোদ্ধা হিসেবে নয় শুধু, বরং স্থানীয় গোত্রগুলোর সম্পর্কে প্রত্যক্ষ জ্ঞানসম্পন্ন একজন পর্যবেক্ষক হিসেবেও।
২. কিং ফিলিপের যুদ্ধ: বেঞ্জামিন চার্চের উত্থান
২.১ যুদ্ধের প্রেক্ষাপট
১৬৭৫ সালে শুরু হওয়া কিং ফিলিপের যুদ্ধ (King Philip’s War) ছিল নিউ ইংল্যান্ডের ইতিহাসে অন্যতম ধ্বংসাত্মক সংঘর্ষ। মেটাকম—যাকে ইংরেজরা “কিং ফিলিপ” নামে ডাকত—ওয়ামপানোয়াগ গোত্রের নেতা এবং উপনিবেশ বিস্তারের বিরুদ্ধে আদিবাসীদের প্রতিরোধের প্রধান মুখ ছিলেন। ভূমি দখল, সম্পদ নিয়ন্ত্রণ, সাংস্কৃতিক দমন, এবং রাজনৈতিক অসমতা মিলিয়ে উপনিবেশবাসী ও আদিবাসীদের মধ্যে উত্তেজনা প্রখর হয়ে উঠেছিল।
যুদ্ধ শুরু হতেই অনেক উপনিবেশিক কর্মকর্তা যুদ্ধকৌশলে সীমাবদ্ধতা টের পান। খোলা ময়দানের ইউরোপীয় ধাঁচের যুদ্ধ এখানে তেমন কার্যকর ছিল না। বনভূমিতে আদিবাসী যোদ্ধাদের গেরিলা-নির্ভর কৌশলের সঙ্গে ইংরেজদের মুখোমুখি সংঘর্ষ অসম ও বিপজ্জনক হয়ে উঠেছিল।
২.২ চার্চের প্রথম অভিযান
ঠিক এই মুহূর্তেই বেঞ্জামিন চার্চ সামনে আসেন। শুরুতে তিনি উপনিবেশবাসীদের একজন স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে যুদ্ধক্ষেত্রে যোগ দেন। খুব দ্রুতই তিনি বুঝতে পারেন যে আদিবাসীদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হলে তাদের মতোই ভাবতে হবে—তাদের চলার পথ, ঘাপটি মেরে আঘাত হানার কৌশল, বনের ভেতর শত্রুকে অনুসরণ করার দক্ষতা—এসবের ওপরই নির্ভর করছে সফলতা।
চার্চ নিজ উদ্যোগে তৈরি করেন একটি ছোট দল, যেখানে আদিবাসীদেরও স্থান দেন। এটি ছিল এক যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত, কারণ তখনকার উপনিবেশ সমাজে আদিবাসীদের প্রতি অবিশ্বাস প্রবল ছিল। কিন্তু চার্চ জানতেন—এই ভূখণ্ডে টিকে থাকতে হলে তাদের জ্ঞান অপরিহার্য।
২.৩ যুদ্ধকৌশলের জন্ম
চার্চ তাঁর দলকে নিয়ে শুরু করেন দ্রুত আক্রমণ, হঠাৎ ঘেরাও, রাতের অভিযান এবং সামান্য সংখ্যক যোদ্ধাকে ব্যবহার করেও কার্যকরী আঘাত হানার পদ্ধতি। এই কৌশল পরে “আমেরিকান রেঞ্জার” ধাঁচের যুদ্ধশৈলী হিসেবে পরিচিতি পায়। অনেক ইতিহাসবিদ তাঁকে “ফাদার অফ আমেরিকান রেঞ্জার্স” বলেও উল্লেখ করেছেন।
২.৪ মেটাকমের পতন
১৬৭৬ সালের আগস্টে চার্চ ও তাঁর দল একটি গুরুত্বপূর্ণ অভিযানে মেটাকমকে চারদিকে থেকে কোণঠাসা করতে সক্ষম হন। চার্চের নেতৃত্বে সংঘটিত অভিযানের ফলেই ওয়ামপানোয়াগ নেতা নিহত হন। এটি কিং ফিলিপের যুদ্ধের প্রধান মোড় ঘুরিয়ে দেয়। যদিও এই ঘটনায় উপনিবেশবাসীরা বিজয় উদযাপন করেছিল, ইতিহাস আজ বলে—এটি নিউ ইংল্যান্ডে আদিবাসীদের রাজনৈতিক স্বাধীনতার এক বড় সমাপ্তি।
৩. প্রথম আমেরিকান রেঞ্জার বাহিনীর জন্ম
৩.১ কৌশলের বৈপ্লবিকতা
চার্চের রেঞ্জার দল ছিল তখনকার প্রচলিত সামরিক ধারণার সম্পূর্ণ বিপরীত। তাঁর বিশ্বাস ছিল—
ছোট দল
দ্রুত গতির চলাফেরা
ভূখণ্ড সম্পর্কে গভীর জ্ঞান
আদিবাসী যোদ্ধাদের সঙ্গে সহযোগিতা
সঠিক সময়ে আক্রমণ
এই মনোভাবের ভিত্তিতেই তিনি গড়ে তুলেছিলেন এক “হাইব্রিড” সামরিক কাঠামো, যা ইউরোপীয় এবং আদিবাসী কৌশলের সমন্বয়ে অভূতপূর্ব ফল দিত।
৩.২ আমেরিকান সামরিক ইতিহাসে গুরুত্ব
চার্চের কৌশল পরবর্তী দুই শতাব্দীতে মার্কিন সামরিক অভিযানে বিশাল প্রভাব ফেলে। ফরাসি-ইন্ডিয়ান যুদ্ধ, আমেরিকান স্বাধীনতা যুদ্ধ—সবখানেই চার্চের প্রবর্তিত পদ্ধতির ছাপ দেখা যায়। তাঁর অভিযানপদ্ধতির ভিত্তিতেই পরবর্তীতে উদ্ভূত হয় আমেরিকান রেঞ্জার বাহিনীর দীর্ঘ ঐতিহ্য।
৪. কিং উইলিয়ামের যুদ্ধ ও পরবর্তী অভিযান
চার্চ শুধু কিং ফিলিপের যুদ্ধেই সীমাবদ্ধ থাকেননি। পরবর্তী যুদ্ধগুলোতেও তাঁর দক্ষতা ও সাহসিকতা জায়গা করে নেয়।
৪.১ কিং উইলিয়ামের যুদ্ধ (১৬৮৯–১৬৯৭)
ফরাসি সেনা ও তাদের মিত্র আদিবাসী গোত্রগুলোর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে চার্চ আবারও রেঞ্জার বাহিনী নিয়ে সক্রিয় হন। মেইন, নোভা স্কোশিয়া, নিউ ব্রান্সউইক—এই সব প্রত্যন্ত অঞ্চলে তিনি অভিযানে নেতৃত্ব দেন। এগুলো ছিল বিপজ্জনক, বরফে ঢাকা, নদী-খাল-বেষ্টিত এলাকা; তবু চার্চ তাঁর ক্ষুরধার কৌশল দিয়ে শত্রুকে একাধিকবার পিছু হটতে বাধ্য করেন।
৪.২ অ্যাকাডিয়া অভিযান
১৬৯৬ সালে অ্যাকাডিয়ার (বর্তমান কানাডার পূর্বাঞ্চল) বিরুদ্ধে চার্চের নেতৃত্বে পরিচালিত অভিযান ছিল অত্যন্ত কৌশলপূর্ণ। তিনি দ্রুতগতির নৌ অভিযান, হঠাৎ হামলা এবং শত্রুর সরবরাহ ব্যবস্থা ধ্বংসের ওপর জোর দেন। যুদ্ধের নির্মম বাস্তবতা এখানে স্পষ্ট হলেও সামরিক কৌশলের দিক থেকে চার্চের ভূমিকা অস্বীকার করা যায় না।
৫. বেঞ্জামিন চার্চের লেখা: Entertaining Passages Relating to Philip’s War
অবসরের পর চার্চ তাঁর স্মৃতিকথা রচনা করেন—এটি তাঁর ছেলে টমাস চার্চ প্রকাশ করেন। বইটির নাম—
Entertaining Passages Relating to Philip’s War
এটি শুধু স্মৃতিকথা নয়; এটি নিউ ইংল্যান্ডের যুদ্ধসংস্কৃতি, আদিবাসীদের সঙ্গে সম্পর্ক, সৈন্যদের জীবনযাপন এবং সীমান্তযুদ্ধের কৌশল সম্পর্কে চমৎকার তথ্যসমৃদ্ধ একটি দলিল। যদিও বইটি চার্চকে কিছুটা নিজের পক্ষে দাঁড় করিয়ে লেখার প্রবণতা রাখে, তবুও এটি ইতিহাস গবেষণার জন্য অমূল্য সম্পদ।
৬. নায়ক না বিতর্কিত চরিত্র?
৬.১ উপনিবেশিক দৃষ্টিতে নায়ক
উপনিবেশিক বর্ণনায় চার্চ ছিলেন সাহসী, বিচক্ষণ এবং নতুন যুদ্ধধারার প্রবর্তক। নিউ ইংল্যান্ড রক্ষা ও স্থায়িত্বের ক্ষেত্রে তাঁর ভূমিকা নিঃসন্দেহে বিশাল।
৬.২ আদিবাসী দৃষ্টিতে সমালোচনা
কিন্তু ইতিহাস একমুখী নয়। আদিবাসী সম্প্রদায়ের অনেকেই তাঁকে দেখেন উপনিবেশ বিস্তারের অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে—যে হাতিয়ার অনেক জাতি, সংস্কৃতি ও জীবনকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিয়েছে। অভিযানে অনেক গ্রাম পুড়ে গেছে, বহু মানুষ প্রাণ হারিয়েছে—এই বাস্তবতাও চার্চের চরিত্রকে বিতর্কিত করে তোলে।
৬.৩ আধুনিক গবেষণার মূল্যায়ন
বর্তমান ইতিহাসবিদরা চার্চকে দেখেন বহুমাত্রিক চরিত্র হিসেবে। তিনি কৌশলী, বাস্তববাদী, রাজনৈতিকভাবে সচেতন এবং উপনিবেশিক বিজয়ের অন্যতম স্থপতি। একই সঙ্গে তিনি সেই কঠোর নীতির অংশ, যা আদিবাসী সমাজগুলোকে ক্ষতবিক্ষত করে দিয়েছিল। তাই চার্চকে শুধু নায়ক বা প্রতিপক্ষ হিসেবে দেখা—দুটোই ইতিহাসকে সরলীকৃত করে ফেলা।
৭. ব্যক্তিজীবন
চার্চ ১৬৬৭ সালে অ্যালিস সাউথওয়ার্থের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। তাঁদের বেশ কয়েকটি সন্তান ছিল। পরিবারের প্রতি চার্চের ভালোবাসা তাঁর স্মৃতিকথার বিভিন্ন অংশে উঠে এসেছে। যুদ্ধ শেষে তিনি জমিজমা দেখাশোনা, কৃষিকাজ এবং স্থানীয় নেতৃত্বে যুক্ত হন। জীবনের শেষদিকে তিনি তুলনামূলক শান্ত জীবন যাপন করেন।
১৭১৮ সালে তাঁর মৃত্যু হয়। প্লিমাথ অঞ্চলে আজও তাঁর স্মৃতিচিহ্ন বিভিন্ন স্থানে সংরক্ষিত রয়েছে।
৮. উত্তরাধিকার
বেঞ্জামিন চার্চের নাম আজ যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ইতিহাসে বিশেষভাবে স্মরণীয়—
প্রথম রেঞ্জার বাহিনীর প্রবর্তক
গেরিলা কৌশলকে উপনিবেশিক সামরিক প্রেক্ষাপটে প্রতিষ্ঠা
আদিবাসী কৌশলকে বোঝা ও প্রয়োগের ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা
উপনিবেশিক নিউ ইংল্যান্ডের সুরক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান
তাঁর কৌশল আজও মার্কিন আর্মি রেঞ্জার্স বাহিনীর ইতিহাসে রয়ে গেছে এক প্রাথমিক ভিত্তি হিসেবে।
বেঞ্জামিন চার্চ এমন এক ঐতিহাসিক চরিত্র, যাকে একমাত্র পরিচয়ে আবদ্ধ করা যায় না। তিনি উপনিবেশের রক্ষক, আবার একই সঙ্গে দখলদারিত্বের চক্রে সক্রিয় অংশগ্রহণকারী। তিনি কৌশলের উদ্ভাবক, সাহসী অভিযাত্রী এবং একই সঙ্গে এক নির্মম যুদ্ধযন্ত্রের সওয়ালকারীও বটে। তাঁর জীবন আমাদের শেখায়—ইতিহাস কখনোই শুধু সাদা-কালো নয়; এটি নানা ছায়ার খেলায় ভরপুর।
চার্চের গল্প নিউ ইংল্যান্ডের বনভূমি, নদী আর সমুদ্রের ঢেউয়ে ছড়িয়ে থাকা এক দীর্ঘ নিশ্বাস—যেখানে বেঁচে থাকার সংগ্রাম, নীতির পরিবর্তন, এবং মানুষের জটিল পরিচয় একে অন্যের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। এই জটিলতাই তাঁকে ইতিহাসের এক চিরবহমান অধ্যায়ে পরিণত করেছে।

















