ঔপনিবেশিক আমেরিকার ইতিহাসে এমন কিছু মুখ রয়েছে, যাদের উপস্থিতি ইতিহাসের পাতায় আলো–ছায়ার কৌতূহলময় ছাপ এঁকে দেয়। কটন মাদার (১৬৬৩–১৭২৮) সেইসব বিরল ব্যক্তিত্বদের মধ্যে অন্যতম। তিনি ছিলেন পুরিটান ধর্মযাজক, লেখক, ইতিহাসবিদ, নৈতিকতাবাদী এবং একই সঙ্গে বিতর্কিত আদর্শের বাহক। তাঁর চিন্তা যেমন সমসাময়িক সমাজকে প্রভাবিত করেছে, তেমনি ভবিষ্যৎ আমেরিকার মানসিক কাঠামোতেও রেখেছে এক দীর্ঘস্থায়ী ছাপ।
কটন মাদারের জীবন যেন পুরিটান সমাজের দ্বিধা–সংকটে ভেজা এক আয়না—যেখানে ধর্মীয় বিশ্বাস, সামাজিক নিয়ন্ত্রণ, জ্ঞানবিস্তার, চিকিৎসা–উদ্ভাবন এবং একই সঙ্গে অজানার প্রতি তীব্র ভীতি—সবকিছুই একসঙ্গে পরস্পরকে আচ্ছন্ন করে আছে। সেলেমের কুখ্যাত ‘উইচ ট্রায়াল’—যা নিয়ে ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি আলোচনা ও অনুশোচনা—সেখানে তাঁর ভূমিকা তাঁকে যেমন বিতর্কে ঘিরে ফেলেছে, তেমনি তাঁর চিকিৎসাবিজ্ঞান–সংক্রান্ত ভাবনাগুলি তাঁকে আধুনিক বিজ্ঞানের পূর্বাভাসদাতাদের সারিতেও বসিয়েছে।
প্রারম্ভিক জীবন ও পারিবারিক ঐতিহ্য
১৬৬৩ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি বোস্টনে কটন মাদারের জন্ম। তাঁর পরিবার ছিল পুরিটান আমেরিকার ‘ধর্মীয় রাজবংশ’। দাদা রিচার্ড মাদার ছিলেন এক প্রভাবশালী পুরোহিত, আর পিতা ইনক্রিজ মাদার ছিলেন প্রখ্যাত ধর্মগুরু, নিউ ইংল্যান্ডের অন্যতম রাজনীতিক পরামর্শদাতা ও হার্ভার্ড কলেজের প্রেসিডেন্ট। পরিবারটি যেন পুরিটান সমাজের বৌদ্ধিক ও নৈতিক কেন্দ্রীয় স্নায়ু।
শৈশব থেকেই কটন ধর্মচিন্তা, নৈতিকতা, ইতিহাস ও ল্যাটিন–গ্রিক সাহিত্যচর্চার মধ্যেই বড় হন। হার্ভার্ডে ভর্তি হন মাত্র বারো বছর বয়সে—যা সেই সময়েও এক বিস্ময়। তাঁর শিক্ষবাস ছিল ভাষা, ধর্মতত্ত্ব, যুক্তিবিদ্যা ও প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের মিশ্রস্রোতে পুঞ্জিত।
একটি লক্ষণীয় ব্যাপার ছিল—তাঁর তোতলামির সমস্যা। ছোটবেলায় এই বাধাটি তাঁকে গভীর আত্মসংযম ও অধ্যবসায় শিখিয়েছিল। পরবর্তীতে বাকশক্তির ওপর অনুশীলনের মাধ্যমে তিনি এক দুর্দান্ত বক্তা হয়ে উঠেছিলেন।
পুরিটান সমাজ ও কটনের ধর্মচেতনা
কটন মাদারের জীবনের কেন্দ্রবিন্দু ছিল পুরিটান ধর্মদর্শন। তিনি বিশ্বাস করতেন সমাজের প্রতিটি অংশই ঈশ্বরের পরিকল্পনার অধীন। মানুষ নৈতিকভাবে সৎ হলে সমাজে শান্তি, আর ভুল হলে ঈশ্বরের শাস্তি অনিবার্য।
তাঁর উপদেশগুলোতে নৈতিকতার কঠোর আহ্বান ছিল—পাপ থেকে বিমুখ হওয়া, আত্মশুদ্ধি, শ্রমনিষ্ঠা, সামাজিক শৃঙ্খলা, এবং ঈশ্বরকে জীবনের সর্বত্র অনুভব করা।
কটন মাদারের ধর্মচিন্তার তিনটি প্রধান স্তম্ভ ছিল—
১. ঈশ্বরকেন্দ্রিক সমাজগঠন
২. পাপ ও শাস্তির বাস্তবতা
৩. মহামিলনবাদী (Millennialist) স্বপ্ন, অর্থাৎ ঈশ্বরের শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়া
এই ভাবনার মধ্যেই জড়িয়ে ছিল তাঁর সমাজ–বিশ্লেষণ এবং রাজনৈতিক অবস্থান।
সেলেম উইচ ট্রায়াল ও কটন মাদারের জটিল ভূমিকা
ইতিহাসে কটন মাদারের নাম শুনলেই যে ঘটনার কথা সামনে আসে—তা হলো ১৬৯২ সালের সেলেমের জাদুবিদ্যা অভিযুক্তদের বিচার।
পটভূমি
ঔপনিবেশিক নিউ ইংল্যান্ড ছিল ধর্মীয় কড়াকড়িময় সমাজ। রোগব্যাধি, অর্থনৈতিক সংকট, জমি–বিতর্ক, মানসিক অস্থিরতা—এসবই মানুষকে ‘অতিপ্রাকৃত ব্যাখ্যা’র দিকে ঠেলে দিত। এর মাঝেই শুরু হয় জাদুকরী শক্তি বা ‘উইচক্রাফট’-এর গুজব।
কটন মাদারের অবস্থান
✔ কটন মাদার জাদুবিদ্যার অস্তিত্বে বিশ্বাস করতেন।
✔ তাঁর বই Wonders of the Invisible World জাদুবিদ্যার ঘটনাগুলোকে ধর্মীয় দৃষ্টিতে ব্যাখ্যা করে।
✔ তিনি বিচারকার্যে বিচারকদের “স্পেকট্রাল এভিডেন্স” অর্থাৎ দৃষ্টিলৌকিক সাক্ষ্য সতর্কতার সঙ্গে ব্যবহারে উৎসাহ দেন—যদিও সম্পূর্ণ বাতিল করেননি।
তাঁর অবস্থান ছিল দ্বিধাগ্রস্ত—তিনি বিচারের পদ্ধতিতে সাবধানতা চাইছিলেন, কিন্তু একই সঙ্গে জাদুবিদ্যার অস্তিত্বের ‘ধর্মীয়’ যুক্তি দিচ্ছিলেন। ফলস্বরূপ, অনেকের চোখে তিনি বিচারকে উৎসাহিত করেছেন; আবার অনেকে মনে করেন তিনি একটি বিশৃঙ্খল সমাজে শৃঙ্খলা স্থাপনের চেষ্টা করেছেন।
১৬৯৩ সালে বিচার বন্ধ হয় এবং পরে এর জন্য পুরিটান সমাজ অনুশোচনা প্রকাশ করে।
কটন মাদারের খ্যাতিতে এই ঘটনা কালো দাগ ফেলে—যদিও তিনি পরে কিছু দুঃখপ্রকাশমূলক লেখাও প্রকাশ করেন।
বিজ্ঞানের প্রতি তাঁর আকর্ষণ: এক অপ্রত্যাশিত মুখ
যদিও তাঁকে অনেকে ধর্মীয় কট্টরপন্থী হিসেবে দেখেন, কটন মাদারের আরেকটি মুখ ছিল—বিজ্ঞানমনস্কতা।
১. টিকাদান (Inoculation) আন্দোলন
১৭২১ সালে বোস্টনে ভয়ঙ্কর গুটিবসন্ত মহামারি ছড়ায়। এই রোগে হাজার হাজার মানুষ মারা যাচ্ছিল।
এই সময় কটন মাদার তাঁর এক দাস ওনেসিমাস থেকে শোনেন আফ্রিকান একটি পদ্ধতির কথা—যেখানে আক্রান্ত ব্যক্তির হালকা সংক্রমিত ফোঁড়ার তরল সুস্থ মানুষের শরীরে প্রবেশ করানো হতো, যাতে শরীরে প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হয়।
এই প্রাক-টিকাদান পদ্ধতি আমেরিকায় প্রথম সমর্থন করেন কটন মাদার এবং চিকিৎসক জ্য়াল্ডার বয়েলস্টন।
সমাজ এতে প্রচণ্ড বিরক্ত হয়—এক দিকে ধর্মীয় আপত্তি, অন্য দিকে বৈজ্ঞানিক সন্দেহ। মাদারের বাড়িতে পাথর ছোড়া হয়, চিঠিতে বোমার হুমকি আসে। কিন্তু তিনি পিছিয়ে যাননি।
পরে বোস্টনে দেখা যায়, যাদের টিকা দেওয়া হয়েছিল তাদের মৃত্যুহার উল্লেখযোগ্যভাবে কম। আধুনিক বিজ্ঞান আজ তাঁকে এই দৃষ্টিতে এক অগ্রদূত হিসেবে দেখে—যদিও তাঁর সময়ে তিনি প্রায় সমাজচ্যুত ছিলেন।
২. ন্যাচারাল হিস্ট্রি ও পরিবেশবিজ্ঞান
তিনি ‘The Christian Philosopher’ বইতে বিজ্ঞানকে ঈশ্বর–প্রদত্ত জ্ঞানের অংশ হিসেবে দেখিয়েছেন—যা পুরিটান সমাজে যথেষ্ট অগ্রবর্তী ভাবনা।
সাহিত্য ও রচনাভান্ডার: এক প্রাবন্ধিক ঝড়
কটন মাদারের রচনাভান্ডার প্রায় ৪০০–এরও বেশি। তাঁর লেখায় ঈশ্বর, মানবজীবন, ইতিহাস, চিকিৎসাবিজ্ঞান, সমাজনীতি—সবকিছুই আছে।
প্রধান গ্রন্থ
Magnalia Christi Americana — নিউ ইংল্যান্ডের ধর্মীয় ইতিহাসের মহাকাব্যসম সারসংকলন।
Essays to Do Good — নৈতিকতা ও সামাজিক দায়িত্ববোধের অগ্রগামী রচনা। বেঞ্জামিন ফ্র্যাঙ্কলিন এই বই থেকে প্রভাবিত হয়েছিলেন।
Wonders of the Invisible World — জাদুবিদ্যা ও অতিপ্রাকৃত ধারণার ব্যাখ্যা।
The Christian Philosopher — বিজ্ঞান ও ধর্মের সম্পর্ক।
কটন মাদারের লেখার ভাষা ছিল উচ্চমাত্রার প্রতীকবহ, ধর্মীয় আভা–মণ্ডিত এবং একই সঙ্গে যুক্তির ঝলকও ছিল। তাঁর ভাষা অনেক সময় কঠোর, অনেক সময় কবিত্বময়।
ঔপনিবেশিক সমাজে কটন মাদারের রাজনৈতিক অবস্থান
যদিও তিনি সরাসরি রাজনৈতিক পদে ছিলেন না, তবুও রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় তাঁর প্রভাব ছিল ব্যাপক।
তিনি রাজা–নির্ধারিত গভার্নরদের সঙ্গে প্রায়ই বিরোধে জড়াতেন।
নিউ ইংল্যান্ডের চার্টার পুনর্বহালের জন্য তাঁর পরিবার ধারাবাহিকভাবে কাজ করেছে।
চার্চ–সমাজ–রাজনীতি—এই ত্রিমুখী সম্পর্ককে তিনি ঈশ্বর–প্রদত্ত কাঠামো মনে করতেন।
তাঁর রাজনৈতিক দর্শন আধুনিক গণতন্ত্রের সঙ্গে সহমত নাও হতে পারে, কিন্তু সেই সময়ের পুরিটান সমাজে তাঁর অবস্থান ছিল বৌদ্ধিকভাবে অগ্রণী এবং প্রভাবশালী।
ব্যক্তিজীবনের ট্র্যাজেডি
কটন মাদারের ব্যক্তিজীবন ছিল বেদনাহত। তাঁর তিন স্ত্রীর মধ্যে দুইজনই অল্প বয়সে মারা যান। তাঁর ১৫ সন্তানের মধ্যে অনেকেই শিশু অবস্থায় মারা যায়। বারবার শোক তাঁকে আঘাত করেছে।
তবে এই ব্যক্তিগত দুঃখ তাঁর ধর্মচিন্তাকে আরও দৃঢ় করেছে—তিনি মনে করতেন প্রতিটি দুঃখের মধ্যেই ঈশ্বরের পরীক্ষা থাকে।
সমালোচনা ও বিতর্ক
কটন মাদারকে নিয়ে ইতিহাসজুড়ে তীব্র মতভেদ রয়েছে।
সমালোচনার কারণ
জাদুবিদ্যা বিচারকে সমর্থন করা
নারীর প্রতি কঠোর দৃষ্টিভঙ্গি
ধর্মীয় কড়াকড়ি
সামাজিক নিয়ন্ত্রণে অতিরিক্ত জোর
সমর্থকদের দৃষ্টিভঙ্গি
তিনি ছিলেন বহুগ্রন্থপ্রণেতা এবং শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়নে অগ্রণী
আধুনিক চিকিৎসা–বিজ্ঞানের পূর্বসূরি
নৈতিক সাহিত্যের বিকাশে পথিকৃৎ
নিউ ইংল্যান্ডের ইতিহাস সংরক্ষণে অসাধারণ ভূমিকা
ইতিহাসবিদদের মতে, কটন মাদার ছিলেন সময়ের সন্তান—সময়ের সীমাবদ্ধতা ও সম্ভাবনা দুই-ই বহন করেছেন।
প্রভাব ও উত্তরাধিকার
আমেরিকার প্রাথমিক ইতিহাসে কটন মাদারের প্রভাব বহু-মাত্রিক।
১. ধর্মীয় ও নৈতিক প্রভাব
পুরিটান মূল্যবোধ আমেরিকার নৈতিক ও সাংস্কৃতিক কাঠামো গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। কটন মাদার তার অন্যতম বুদ্ধিবৃত্তিক স্থপতি।
২. বিজ্ঞান–চিন্তা
গুটিবসন্ত টিকাদান আন্দোলনে তাঁর অবদান আধুনিক স্বাস্থ্যব্যবস্থার ভবিষ্যৎকে দ্রুততর করেছে।
৩. সাহিত্য ও ইতিহাসচর্চা
নিউ ইংল্যান্ডের ইতিহাস, জীবনীগ্রন্থ ও সমাজ–গবেষণায় তাঁর কাজ এখনও মূল্যবান।
৪. সমালোচনামূলক বিতর্কের উত্থান
সেলেম বিচার নিয়ে আজও তিনি বিতর্কিত, যা ইতিহাসকে আরও আত্মসমালোচনামূলক করেছে।
কটন মাদার — এক মানবিক, আবার জটিল চরিত্র
তাঁকে একদিকে দোষ দিলে যেমন ভুল হয়, অন্যদিকে তাকে দেবত্ব দান করলেও ন্যায় হয় না। তিনি ছিলেন—
ধর্মের প্রবল সমর্থক
ভয়ের আবহে বন্দী সমাজের সন্তান
বিজ্ঞানের সাহসী সমর্থক
আবার একই সঙ্গে সামাজিকভাবে রক্ষণশীল
মানসিকভাবে উদ্বিগ্ন ও আত্মসংযমী
বহুমাত্রিক লেখক
এবং বিতর্কে জড়ানো মানুষ
তাঁর জীবন যেন আমেরিকার শৈশব—আশা, অন্ধবিশ্বাস, দুঃসাহস, ভুল, শিক্ষালাভ—সবকিছুর সমাহার।
কটন মাদারের জীবনচিত্র আমাদের শেখায়—কোনো মানুষকে এক বাক্যে বিচার করা যায় না। তাঁর জীবন পুরিটান সমাজের ভঙ্গুরতা, ভয়, জ্ঞানচর্চা, নৈতিকতার দাবি, এবং সামাজিক পরিবর্তনের এক বহুবর্ণ দিগন্ত।
তিনি একজন কট্টর ধর্মীয় নেতা ছিলেন—একই সঙ্গে একজন আধুনিক বিজ্ঞান–সমর্থকও। তিনি নৈতিকতার শিক্ষক ছিলেন—আবার একই সঙ্গে সমাজের ভুল বিচার প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিলেন। তাঁর লেখনী আমেরিকার মানচিত্রকে ভাষা দিয়েছে—আবার তারই কিছু চিন্তা আজ প্রশ্নবিদ্ধ।
এটাই কটন মাদার—ঔপনিবেশিক আমেরিকার জটিল মানসজগতের এক উজ্জ্বল অথচ ছায়াময় প্রতিচ্ছবি।









