Becoming a Writer by Dorothea Brande
ডরোথিয়া ব্র্যান্ডের Becoming a Writer (১৯৩৪ সালে প্রকাশিত) এখনো লেখালেখি-ইচ্ছুক ব্যক্তিদের কাছে এক মাইলফলক-সদৃশ গ্রন্থ। লেখালেখির কৌশল, ভাষাশৈলী কিংবা রূপগত বিষয়ের পাশাপাশি তিনি গভীরভাবে লেখকের মানসিক ও আবেগগত প্রস্তুতির কথা বলেন। বেশির ভাগ সময় আমরা ভাবি, “ভালো লেখা” জন্ম নেয় মূলত কারিগরি দক্ষতা থেকে—কিন্তু ব্র্যান্ড দেখিয়েছেন, সফল লেখার মূলতম শর্ত হলো লেখকের মনের গঠন ও সৃজনশীল প্রবৃত্তি উন্মোচন করা।
এই বইয়ের মূল বক্তব্য হলো, আমাদের সবার মধ্যেই এক সুপ্ত সৃজনশীল শক্তি রয়েছে, যার বিকাশ ঘটাতে প্রয়োজন আত্মঅনুশীলন, আত্মবিশ্বাস এবং সুশৃঙ্খল কর্মপদ্ধতি। ব্র্যান্ড মনে করেন, লেখালেখি কেবল মেধার বিষয় নয়; বরং এটি একাধারে মানসিক, আবেগগত ও ব্যবহারিক অনুশীলনের ফল। সুতরাং, সৃজনশীল লেখালেখির জন্য দরকার নিয়মিত রুটিন তৈরি করা, নিজের “অবজারভার সেলফ” বা পর্যবেক্ষক সত্তাকে জাগ্রত রাখা, সমালোচনার মুখোমুখি হওয়ার মানসিক প্রস্তুতি নেওয়া, এবং একসময় অনুপ্রেরণা বা ‘মিউজ’ কিভাবে প্রতিদিনের চর্চার মাধ্যমে দৃঢ় হয়ে ওঠে তা বোঝা।
এবার আমরা বইটির প্রতিটি অধ্যায়কে ধাপে ধাপে পর্যালোচনা করব। প্রত্যেকটি অধ্যায় কিভাবে পরস্পরসম্পর্কিত এবং কীভাবে পাঠককে একজন আত্মবিশ্বাসী ও দক্ষ লেখকে পরিণত করতে পারে, তার বিশদ বিবরণ পাওয়া যাবে এই সারসংক্ষেপে।
অধ্যায় ১: চারটি প্রতিবন্ধকতা
প্রথম অধ্যায়ে, ব্র্যান্ড লেখকদের সামনে সাধারণত যে চারটি বড় বাধা দেখা দেয়, সেগুলো পরিষ্কারভাবে চিহ্নিত করেন।
- লেখার সময় বসতে না পারা: অনেকেই লেখার বাসনা মনে পোষণ করলেও খাতা-কলম বা কম্পিউটারের সামনে বসে লেখার কাজটা শুরু করতে পারেন না, কিংবা বারবার টালবাহানা করে সময়ক্ষেপণ করেন।
- আত্মবিশ্বাসের অভাব: “আমি কি সত্যি লিখতে পারব?”, “আমার লেখা কি কাউকে স্পর্শ করবে?”—এ ধরনের প্রশ্ন মানসিক চাপে পরিণত হয়।
- স্বনিয়ন্ত্রণ বা শৃঙ্খলার অভাব: পরিকল্পনা থাকলেও দৈনন্দিন জীবনের ব্যস্ততা ও নানা অজুহাতে নিয়মিত লিখে যাওয়া সম্ভব হয় না।
- আত্মপ্রকাশের স্বতঃস্ফূর্ততায় ঘাটতি: লিখতে বসলে হয়তো নিজেরই লেখা প্রাণহীন বা ভোঁতা মনে হয়; স্বতঃস্ফূর্ততায় বাধা আসে।
এই চারটি সমস্যা একেকজনের ক্ষেত্রে একেকভাবে প্রকাশ পায়, তবে এগুলির অস্তিত্ব সবার জন্যই কমবেশি সত্য। ব্র্যান্ড এগুলোকে প্রথমে স্বীকার করে নেওয়ার উপর জোর দেন। যখন আমরা সমস্যা চিহ্নিত করি, তখনই সেগুলো সমাধানের জন্য পরিকল্পিত পদক্ষেপ নিতে পারি। এটি মূলত বইটির পরবর্তী অংশে দেওয়া বিভিন্ন কৌশল ও দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণের প্রস্তুতি হিসেবে কাজ করে।
অধ্যায় ২: লেখকের প্রস্তুতি
দ্বিতীয় অধ্যায়ে, ব্র্যান্ড লেখক সত্তা তৈরির জন্য ‘প্রস্তুতি’কে বিশেষভাবে গুরুত্ব দিয়েছেন। তিনি বলেন, কেবল লেখার প্রতি বাসনা থাকাই যথেষ্ট নয়; লেখাকে দৈনন্দিন জীবনের একটি উদ্দেশ্যমূলক অনুশীলনে পরিণত করতে হবে। এই প্রস্তুতির দুটি প্রধান দিক আছে:
- পরিবেশ ও সময়সূচি গঠন: নির্দিষ্ট একটা সময় বেছে নেওয়া—সকাল, দুপুর বা রাত—যখন আপনি প্রতিদিন লিখবেন। এমন একটি জায়গা তৈরি করা জরুরি, যেখানে আপনাকে কম-বেশি ব্যাঘাতহীন থাকতে হবে। অনেক সময় “আমি কখনো নিরিবিলি সময় পাই না” বা “একান্তই সময় নেই” এই অজুহাতে কাজ শুরু হয় না। ব্র্যান্ড বলেন, অল্প সময়ের মধ্যেও যদি আপনি সেটাকে সৃজনশীল কাজে নিয়মিত ব্যয় করেন, তবে ধীরে ধীরে অভ্যাস গড়ে উঠবে।
- মানসিক প্রস্তুতি: নিজের মনে ডুব দেওয়া, শরীর ও মনকে লেখার জন্য প্রস্তুত করা—এগুলোর মধ্যে আসে আত্মবিশ্বাস, হতাশাকে প্রতিহত করা, এবং ‘বাহ্যিক’ জীবনের চাপে একঘন্টা বা ত্রিশ মিনিটের জন্য হলেও নিভৃত হওয়া।
এই অধ্যায়ের সারকথা হলো, লেখক হয়ে ওঠার প্রক্রিয়া শুরু হয় “ইচ্ছার” সাথে “শৃঙ্খলা”র মেলবন্ধনে। লেখালেখিকে গুরুত্ব দিয়ে, এটির জন্য পরিবেশ-সময় বরাদ্দ করে, এবং মানসিকভাবে নিজেকে প্রস্তুত করেই একজন লেখক তার পথে এগিয়ে যেতে পারেন।
অধ্যায় ৩: লেখকের দুই দিক
বিখ্যাত এই অধ্যায়ে, ব্র্যান্ড আলোকপাত করেছেন লেখকের “সচেতন মন” ও “অচেতন (বা অবচেতন) মন” এর উপর। তাঁর মতে, একজন সফল লেখককে এ দু’টি সত্তার মধ্যে সেতুবন্ধন ঘটাতে হয়:
- সচেতন মন: যুক্তি, বিশ্লেষণ, পরিকল্পনা ও সম্পাদনার কাজ করে। ভাষা, রীতি, ব্যাকরণ, কাঠামো ইত্যাদির শৈল্পিক বিন্যাস এই মনের জগতে হয়।
- অচেতন (বা অবচেতন) মন: প্রকৃত সৃজনশীলতার উৎস। হঠাৎ উঁকি দেওয়া আইডিয়া, অন্তর্দৃষ্টি, পরাবাস্তব বা কল্পনাময় চিত্র—সব আসে এই স্তর থেকে।
অনেকে হয়তো অতিমাত্রায় সচেতন মনের উপর নির্ভর করে, ফলে সৃজনশীল স্পন্দন গুম হয়ে যায়। আবার কেউ কেউ শুধুই “অনুপ্রেরণার” অপেক্ষায় বসে থাকেন, আর ফেলে রাখেন লেখা শৃঙ্খলার অভাবে। ব্র্যান্ডের মূল কথা, এই দু’টি শক্তির মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করতে হবে। অচেতন মনে অবারিত প্রবাহ ঘটতে দিলে, পরে সচেতন মন দিয়ে সেই কাঁচা ভাবনাকে পরিশীলিত করতে হবে। এই অধ্যায়ে তিনি জোর দেন স্বতঃস্ফূর্ততা ও শৃঙ্খলার কৌশলগত মিশেলের উপর।
অধ্যায় ৪: একজন লেখকের কৌশল
চতুর্থ অধ্যায়ে ব্র্যান্ড বাস্তবসম্মত কিছু অনুশীলনী ও কৌশল দেয়েছেন, যেগুলো সচেতন এবং অবচেতন—উভয় মনকে উদ্দীপিত করে রাখতে সাহায্য করে। এর মধ্যে প্রধান তিনটি হল—
- নিয়মিত লেখার অভ্যাস: প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে লিখতে বসে যাওয়া, সেটা ভোর হোক বা গভীর রাত। এই সময়ে কী লিখছেন, তাৎক্ষণিকভাবে ভালো লাগছে কি না—এ বিষয়ে বেশি না ভেবে একটানা কিছুক্ষণ লেখার চেষ্টা করতে হবে।
- “অনুমতি” দেওয়া: নিজেকে অনুমতি দেওয়া, যেন প্রথম খসড়াটা যত অগোছালোই হোক, তা লিখে ফেলা যায়। এই পর্যায়ে সম্পাদনা বা মূল্যায়ন থেকে বিরত থাকা জরুরি।
- লিখতে “প্রস্তুত” হওয়া: কোনও নির্দিষ্ট সংকেত বা অভ্যাস গড়ে তোলা—যেমন কফির কাপে চুমুক দেওয়া, নির্দিষ্ট ডেস্কে বসা ইত্যাদি—যা মনকে অবচেতন স্তরে লেখার মোডে নিয়ে যায়।
এই “লেখার কৌশল” অধ্যায়ে Brande মূলত দুই মনের মধ্যে সেতু স্থাপনের প্রক্রিয়া বর্ণনা করেন। ফলস্বরূপ, নিয়মিত অনুশীলনের মাধ্যমে অবচেতন মন লেখকের ডাকে সাড়া দিতে শেখে এবং “ইচ্ছেমতো” সময়ে লিখে ফেলা সহজ হয়ে ওঠে।
অধ্যায় ৫: সমালোচকরা এবং আপনি
পঞ্চম অধ্যায়ে তিনি লেখালেখিতে সমালোচনার প্রভাব নিয়ে আলোচনা করেন। লেখককে দু’ধরনের সমালোচনার মুখোমুখি হতে হয়—
- বাহ্যিক সমালোচক: সম্পাদক, প্রকাশক, পাঠক, বা সহকর্মীরা আপনার লেখা পড়ে মতামত দেয়। এটা গঠনমূলক বা বিরূপ—দুই রকমই হতে পারে।
- অভ্যন্তরীণ সমালোচক: নিজের মনের মধ্যকার সন্দেহ ও ভয়। এটি অনেক সময় যুক্তিহীনভাবে কাজ করে, যেমন “আমি কখনোই ভালো লিখতে পারব না” কিংবা “সবাই নিশ্চয়ই হাসবে!”
ব্র্যান্ড বোঝাতে চান যে, বাহ্যিক সমালোচনার মধ্যে যদি বাস্তব উপদেশ বা পরামর্শ থাকে, তাহলে সেটাকে গ্রহণ করতে হবে, তবে তা যেন আমাদের আত্মবিশ্বাস পুরোপুরি গুঁড়িয়ে না দেয়। অন্যদিকে, অভ্যন্তরীণ সমালোচককে প্রশ্ন করতে হবে—এটি কি স্রেফ নিরাশার কণ্ঠস্বর, না কি বাস্তব কোনো সমস্যা নির্দেশ করছে? সবচেয়ে ভালো উপায় হলো, গঠনমূলক সমালোচনাকে স্বাগত জানিয়ে সংশোধিত হওয়া এবং মাত্রাতিরিক্ত আত্মঅবিশ্বাস বা অহংকার—দুটিকেই পরিহার করা।
অধ্যায় ৬: লেখক হিসেবে পড়াশোনা
এই অধ্যায়ে ব্র্যান্ড গঠনমূলকভাবে “পড়া”র গুরুত্ব নিয়ে কথা বলেন। শুধু আনন্দের জন্য পড়া বা পছন্দের লেখকের অনুরূপ লেখা পড়া যথেষ্ট নয়; লেখকের উচিত বিশ্লেষণাত্মক মন নিয়ে পড়া। তিনি বলেন:
- শৈলীর বিশ্লেষণ: লেখক কীভাবে বাক্য গঠন করেছেন? অনুচ্ছেদ-সজ্জা কীভাবে পরিকল্পিত? চরিত্রায়ন কেমন? টানটান উত্তেজনা সৃষ্টি কীভাবে হয়েছে?
- নোট রাখা: পড়তে গিয়ে অবাক করা বা অনুপ্রাণিত করা অংশগুলি চিহ্নিত করা, কেন এই অংশটি “হাজির” বা “ফ্ল্যাট” মনে হচ্ছে তা নিয়ে ভাবা।
- বিভিন্ন ধারা ও ঘরানায় পড়া: নিজের পছন্দের জঁর বা শৈলীর বাইরে গিয়ে পড়া, যাতে বৈচিত্র্যময় কৌশল ও ধ্যানধারণা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়।
উদ্দেশ্য হলো, কীভাবে ভালো লেখা তৈরি হয় সেটি বোঝা এবং সেই জ্ঞানকে নিজের লেখায় প্রয়োগ করা। তবে খুব বেশি বিশ্লেষণী হয়ে পড়ার আনন্দ হারিয়ে ফেলাও ঠিক নয়। আনন্দের সঙ্গে বিশ্লেষণ এই দুইয়ের মিশ্রণই লেখককে সমৃদ্ধ করে।
অধ্যায় ৭: অনুকরণের ভ্রান্তি
সপ্তম অধ্যায়ে ব্র্যান্ড পাঠককে সতর্ক করেন অতি-অনুকরণের বিপদ সম্পর্কে। তিনি বলেন, বড় লেখকদের কাজের শৈলী বা কাঠামো দেখে শিক্ষা নেওয়া ঠিক আছে, কিন্তু হুবহু কপি করতে গেলে মৌলিকত্বের বারোটা বাজে। লেখার প্রাণশক্তি বা নিজস্ব স্বর হারিয়ে ফেলে সেই কাজ।
একজন লেখক জন্ম নেয় তার নিজস্ব অভিজ্ঞতা, অনুভূতি ও দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। যখন আমরা অন্যের লেখনশৈলী ঠিক 그대로 আরোপ করি, তখন আমাদের অন্তর্লীন স্বর চাপা পড়ে। এতে পাঠকও বুঝতে পারে যে লেখায় কোনো আসল অন্তর্দৃষ্টি বা ব্যক্তিগত ছাপ নেই। ফলে লেখা হয়ে যায় নকল বা “ডেরিভেটিভ।”
ব্র্যান্ড মনে করিয়ে দেন, ব্যাকরণ, চরিত্রায়ন বা প্লট নির্মাণের মতো টেকনিকগুলো রপ্ত করা যায়, কিন্তু সবশেষে লেখার authentic শক্তি আসে লেখা যারা করছে তার নিজস্ব ভুবন থেকে। এই অধ্যায়ে তিনি মৌলিক চিন্তাধারা বিকাশে উৎসাহ দেন, যাতে অনুকরণ নয়, বরং নিজের স্বতন্ত্র কণ্ঠস্বর প্রতিষ্ঠা হয়।
অধ্যায় ৮: মৌলিকতার উৎস
অষ্টম অধ্যায়ে ব্র্যান্ড সরাসরি আলোচনা করেন, মৌলিকতা কীভাবে বিকাশ করা যায়। অনেক নতুন লেখকের মনে শঙ্কা থাকে—“আমার তো কোনো সত্যিকারের ‘নতুন’ আইডিয়া নেই!” ব্র্যান্ড উত্তর দেন যে, মৌলিক লেখা মানে এই নয় যে বিষয়বস্তু সম্পূর্ণ নতুন হতে হবে; বরং সেটির বিশেষ উপস্থাপন, লেখকের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গিই লেখাকে আলাদা করে তোলে।
তিনি উল্লেখ করেন:
- নিজস্ব জীবন ও অভিজ্ঞতার মূল্য: আপনার দেখা, শোনা ও উপলব্ধ কোনো বিষয়ই অমূলক নয়। সেগুলোকে নির্দ্বিধায় শৈল্পিক কাঠামোয় আনুন।
- অবচেতনকে মুক্ত রাখা: ডায়েরি লেখা বা ফ্রি-রাইটিংয়ের মাধ্যমে মনের কোণায় লুকিয়ে থাকা ভাবনাকে বাইরে নিয়ে আসুন। কখনো একজোড়া উদ্ভট ধারণা একত্র হয়ে দারুণ কিছুর জন্ম দিতে পারে।
- ভয় ও দ্বিধা পরিহার: কেউ মনে করতে পারে তার ধারণাগুলো বিচিত্র বা “খাপছাড়া।” কিন্তু এই বিচিত্রতাই মৌলিকত্বের জন্ম দেয়।
এই অধ্যায়ের মূলভাব, আসল সৃজনশীলতা লেখকের আত্মপরিচয় ও আত্মবিশ্বাসের গভীর মেলবন্ধন থেকে আসে। বাহ্যিকভাবে পরিচিত কোনো বিষয়ও একান্ত ব্যক্তিগত দৃষ্টিকোণ থেকে অশেষ মৌলিক হয়ে উঠতে পারে।
অধ্যায় ৯: লেখকের বিনোদন
নবম অধ্যায়ে ব্র্যান্ড লিখেছেন “বিনোদন” বা “বিশ্রাম” কেন লেখার জন্যও অপরিহার্য। অনেকেই মনে করেন, লেখালেখি মানেই ঘষামাজা, অনুশীলন ও অধ্যবসায়। কিন্তু ব্র্যান্ড বলেন, লেখায় অচেতন মনের অবাধ বিচরণ ও পূর্ণতা নিশ্চিত করতে মাঝে মাঝে সৃজনশীল বিরতি বা বিনোদন দরকার।
- প্রকৃতির সংস্পর্শ: পার্কে হাঁটতে যাওয়া, পাহাড়ে চড়া বা সমুদ্র-তটে ঘোরাফেরা—এতে মন উদার হয়, মাথায় নতুন চিন্তা উদয় হয়।
- হবি অনুশীলন: অন্যান্য সৃষ্টিশীল কাজ—চিত্রাঙ্কন, সঙ্গীত, বাগান করা—এসবের মাধ্যমে মন নতুন উদ্দীপনা পায়।
- সামাজিক সংযোগ: একদল মানুষের সঙ্গে আড্ডা, কোনো অনুষ্ঠানে যাওয়া—এতে নতুন অভিজ্ঞতা ও চরিত্রগত বৈচিত্র্যকে পর্যবেক্ষণ করার সুযোগ মিলবে।
মোট কথা, সৃষ্টিশীলতাকে টিকিয়ে রাখতে হলে কেবল লিখে যাওয়াই নয়, মাঝে মাঝে মুক্ত পরিবেশে স্বস্তিদায়ক অভিজ্ঞতা নেওয়া দরকার। এটি অবচেতন মনকে ফিরে এসে নতুন উদ্যমে কাজ করতে সহায়তা করে।
অধ্যায় ১০: অনুকরণ সম্পর্কে (পুনরায়)
আগের অধ্যায়ে অনুকরণের ক্ষতি নিয়ে বলার পর, এই অধ্যায়ে ব্র্যান্ড কিছু ইতিবাচক দিকও তুলে ধরেন। তিনি বলেন, “অনুকরণ” আর “শিক্ষা নেওয়া” এক জিনিস নয়। কখনো কখনো দক্ষ লেখকের কোনো বিশেষ গুণ বা কারিগরি কৌশল অনুশীলন করা ভালো:
- ভাষার ব্যবহারের সূক্ষ্মতা: কোনো লেখক কীভাবে সংলাপ পরিচালনা করেন, কীভাবে চরিত্রদের কণ্ঠস্বর আলাদা আলাদা রাখেন—এগুলো অনুশীলন করে দেখা যেতে পারে।
- গঠনমূলক বিশ্লেষণ: অন্যের লেখায় দৃশ্য-রূপান্তর, টাইম জাম্প, বা প্লট টুইস্টের পদ্ধতি অনুশীলন করা।
এসবই করা যেতে পারে, কিন্তু তার মূল শর্ত হলো নিজের মৌলিক ভাবনা ও অভিজ্ঞতা দিয়ে সেগুলোকে নিজের মতো করে রূপান্তর করা। একজন শিল্পী যেমন বিখ্যাত চিত্রশিল্পীদের আঁকা দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে নিজের হাতে আঁকে, তেমনি একজন লেখকও সাহিত্যিক “টুলবক্স” সমৃদ্ধ করতে পারেন, তবে নিজের স্বরের প্রতি সৎ থাকতে হবে।
অধ্যায় ১১: বিপর্যয়ের ক্ষণে (The Slough of Despond)
এ অধ্যায়ে ব্র্যান্ড আলোচনা করেন সেই গভীর হতাশার মুহূর্ত নিয়ে, যখন লেখক মনে করেন সব ফুরিয়ে গেছে—কোনো আইডিয়া আসছে না, ভাষা ঠিকমতো কাজ করছে না, বা একের পর এক প্রত্যাখ্যানের চিঠি হাতের মধ্যে এসে জমছে। ব্র্যান্ড এ অবস্থা থেকে বের হওয়ার জন্য কয়েকটি পদক্ষেপের কথা বলেন:
- কারণ নির্ণয়: বেশি কাজের চাপে বা অতিরিক্ত আত্মসমালোচনার ফলে হতাশা আসতে পারে। কোথায় সমস্যা হচ্ছে, আগে তা চিহ্নিত করুন।
- বিশ্রাম ও পুনর্মূল্যায়ন: একটানা একই কাজ করলে মন ক্লান্ত হয়; হয়তো কিছুদিন ভিন্ন কিছু করে অথবা অন্য কোনো সৃষ্টিশীল উপায়ে নিজেকে ব্যস্ত রেখে ফিরে আসা ভালো।
- পূর্বের সাফল্য বা আনন্দদায়ক মুহূর্ত মনে রাখা: যেসব পুরোনো লেখা বা অভিজ্ঞতা আত্মবিশ্বাস বাড়ায়, সেগুলো আবার পড়তে পারেন, যাতে আগের উদ্দীপনা ফিরে আসে।
- পরিচিত মানুষের সহায়তা: লেখক বন্ধু, পরিবার বা বিশ্বস্ত সমালোচক; এদের সাথে কথা বলে বোঝার চেষ্টা করুন কোনো কাঠামোগত সমস্যায় পড়েছেন কি না।
ব্র্যান্ড মনে করিয়ে দেন, প্রত্যেক লেখক, এমনকি বিখ্যাতরাও, এই চরম হতাশার মুখোমুখি হন। পার্থক্য হলো—কে কীভাবে সেই হতাশাকে কাটিয়ে উঠে সামনের দিকে এগিয়ে যায়।
অধ্যায় ১২: চূড়ান্ত বিশ্লেষণ
শেষ অধ্যায়ে ব্র্যান্ড তার প্রধান বিষয়গুলো সংক্ষিপ্তাকারে পুনর্ব্যক্ত করেন। তিনি স্পষ্ট করেন—
- লেখালেখি করা মানে “জিনিয়াস” হয়ে জন্মানো নয়; বরং নিয়মিত চর্চা ও মানসিক প্রস্তুতির ফল।
- সচেতন ও অবচেতন—এই দুই সত্তার সুসমন্বয় ঘটানোই লেখার আসল সাফল্যের চাবিকাঠি।
- সমালোচনা আসবেই—একদিকে বাহ্যিক (সম্পাদক, পাঠক) এবং অন্যদিকে অভ্যন্তরীণ (নিজের মন) থেকে। স্থিতধী থেকে সমালোচনা গ্রহণ করা শিখতে হবে।
- পড়াশোনার সময় বিশ্লেষণী দৃষ্টিভঙ্গি রাখুন। যেকোনো ভালো লেখা কীভাবে তৈরি হলো, কেন কাজ করছে বা করছে না—এসব বুঝতে চেষ্টা করুন।
- অন্যের লেখা থেকে শিক্ষা নেওয়া ঠিক, তবে অন্ধভাবে অনুকরণ নয়। নিজের স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখতে হবে।
সর্বোপরি, ব্র্যান্ড লেখকদের কাছে এই বার্তা দেন: লেখার পথচলা এক দিন বা এক বছরের ব্যাপার নয়; বরং আজীবনের অনুশীলন ও অভ্যাসের মধ্য দিয়ে “লেখক” পরিচয় গড়ে ওঠে। উৎসাহ ও দৃঢ় সংকল্পই একজন নবীনকে পরিণত লেখকে পরিণত করে, আর সেখানেই রয়েছে সৃষ্টির অসীম সম্ভাবনা।
উপসংহার
ডরোথিয়া ব্র্যান্ডের Becoming a Writer বইটি এত দশক পরেও অমলিন কারণ এটি লেখকসত্তার অন্তর্গত বিষয়গুলোর উপর সমানভাবে জোর দেয়, যেমন দেয় কারিগরি দক্ষতার উপর। লেখালেখিতে আমরা যেসব সাধারণ সংকট—ভয়, আত্মবিশ্বাসহীনতা, অনুপ্রেরণার অভাব—এসব নিয়ে ভুগি, সেগুলো কীভাবে ধীরে ধীরে কাটিয়ে ওঠা যায়, ব্র্যান্ড অত্যন্ত সরল ও প্রাঞ্জল ভাষায় তা ব্যাখ্যা করেছেন।
তার মূলমন্ত্র হলো—
- নিয়মিত ও সুশৃঙ্খলভাবে লেখার অভ্যাস গড়ে তোলা: দৈনন্দিন চর্চা অবচেতনকে প্রস্তুত করে তোলে, ফলে সময়মতো কলম ধরলে শব্দেরা সহজে আসতে শুরু করে।
- অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক সমালোচনার মুখোমুখি হওয়ার দক্ষতা অর্জন: নিজেকে দমিয়ে না রেখে ভুল থেকে শিক্ষা নেওয়া এবং স্বকীয়তা বজায় রাখা।
- পড়ার ক্ষেত্রে সমান যত্নবান ও বিশ্লেষণাত্মক হওয়া: বড় লেখকদের কাছ থেকে কৌশল শিখে নিজের লেখায় প্রয়োগ করা।
- বিনোদন ও বিশ্রামকে অবহেলা না করা: নিছক মস্তিষ্কপ্রসূত শ্রম নয়, বরং মানসিক পরিমণ্ডলকে সতেজ রাখতে জীবনযাপনের বিভিন্ন দিককে গুরুত্ব দেওয়া।
সব মিলিয়ে, ব্র্যান্ডের এই বই আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, সৃষ্টিশীল লেখালেখি কেবল অনুপ্রেরণার অপেক্ষায় বসে থাকা নয়, বরং এটি নিষ্ঠা, প্রাত্যহিক চর্চা এবং অচেতন মনের সাথে সচেতন চিন্তার সুসমন্বয়ের ফল। লেখক হয়ে ওঠা মানে আত্মপরিচয়কে প্রতিনিয়ত জাগিয়ে রাখা—উত্থান-পতন, আনন্দ-হতাশা সবকিছুর মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাওয়া। আর এই যাত্রায় ব্র্যান্ডের অন্তর্দৃষ্টি যে অমূল্য সম্পদ, তা অস্বীকার করার উপায় নেই।