Jean-Auguste-Dominique Ingres

Jean-Auguste-Dominique Ingres

জঁ-অগুস্ত-দোমিনিক অ্যাংগ্র ছিলেন একজন বিখ্যাত ফরাসি চিত্রশিল্পী।

তিনি জন্মগ্রহণ করেন ২৯ আগস্ট, ১৭৮০ সালে।

জন্মস্থান ছিল ফ্রান্সের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় শহর মনতবঁ (Montauban)।

তাঁর পিতার নাম জঁ-মারি-জোসেফ অ্যাংগ্র (Jean-Marie-Joseph Ingres)।

তাঁর পিতা ছিলেন এক বহুমুখী শিল্পী — ভাস্কর, চিত্রশিল্পী ও সঙ্গীত শিক্ষক।

মায়ের নাম অ্যান মুথে (Anne Moulet)।

ছোটবেলা থেকেই অ্যাংগ্র শিল্পের প্রতি আগ্রহী ছিলেন।

তিনি অল্প বয়সে অঙ্কন ও সঙ্গীত শেখা শুরু করেন।

সঙ্গীতে তিনি বেহালা বাজাতেন দক্ষতার সাথে।

অ্যাংগ্র জীবনের প্রথমদিকে সঙ্গীতশিল্পী হওয়ার কথাও ভেবেছিলেন।

১৭৯১ সালে তিনি টুলুজ শহরের এক আর্ট স্কুলে ভর্তি হন।

তাঁর প্রথম শিক্ষক ছিলেন গিয়োম-জোসেফ রোক (Guillaume-Joseph Roques)।

রোক ছিলেন রাফায়েলের কাজের অনুরাগী, যা অ্যাংগ্রের ওপর গভীর প্রভাব ফেলে।

১৭৯৭ সালে অ্যাংগ্র প্যারিসে চলে আসেন শিল্পশিক্ষার জন্য।

সেখানে তিনি জ্যাক-লুই ডাভিদের ছাত্র হন।

জ্যাক-লুই ডাভিদ ছিলেন নব্য-ধ্রুপদী (Neoclassical) আন্দোলনের প্রধান চিত্রশিল্পী।

অ্যাংগ্র তাঁর গুরু ডাভিদের কাছ থেকে ক্লাসিকাল শৈলী ও কঠোর রূপনিয়ন্ত্রণ শিখেছিলেন।

১৮০১ সালে তিনি “Prix de Rome” নামে ফ্রান্সের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ আর্ট পুরস্কার জেতেন।

বিজয়ী কাজটির নাম ছিল “Achilles Receiving the Ambassadors of Agamemnon.”

পুরস্কার হিসেবে তিনি রোমে পড়াশোনার সুযোগ পান।

কিন্তু তহবিলের অভাবে তিনি ১৮০৬ সাল পর্যন্ত রোম যেতে পারেননি।

১৮০৬ সালে তিনি অবশেষে রোমে যান এবং সেখানে বহু বছর কাটান।

রোমে থাকাকালীন তিনি রাফায়েল ও প্রাচীন রোমান শিল্প অধ্যয়ন করেন।

তাঁর কাজের মধ্যে রাফায়েল-ধর্মী কোমলতা ও রেখার নিখুঁততা দেখা যায়।

তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত ছবিগুলির একটি হলো “Grande Odalisque” (১৮১৪)।

এই চিত্রে একটি নগ্ন নারীকে এক্সোটিক ভঙ্গিতে উপস্থাপন করা হয়েছে।

কাজটি নিয়ে সমালোচনা হয়েছিল কারণ শরীরের গঠন বাস্তবের তুলনায় অতিরিক্ত প্রসারিত ছিল।

তবে পরবর্তীতে এই কাজটি শিল্পকলার ইতিহাসে এক অনন্য নিদর্শন হিসেবে স্বীকৃত হয়।

অ্যাংগ্র ছিলেন রেখার প্রতি গভীরভাবে নিবেদিত।

তিনি বলতেন, “Drawing is the honesty of art.”

তিনি বিশ্বাস করতেন রঙ নয়, রেখাই চিত্রকলার আত্মা।

অ্যাংগ্র ইতিহাসচিত্র ও প্রতিকৃতি উভয় ক্ষেত্রেই দক্ষ ছিলেন।

তাঁর প্রাথমিক কাজগুলিতে নেপোলিয়ন বোনাপার্টের প্রভাব দেখা যায়।

১৮০৬ সালে আঁকা “Napoleon I on His Imperial Throne” তাঁর বিখ্যাত প্রাথমিক কাজ।

এই চিত্রে নেপোলিয়নকে এক দেবতাসদৃশ রাজারূপে উপস্থাপন করা হয়েছে।

তাঁর এই চিত্র ফরাসি সাম্রাজ্যবাদের প্রতীক হিসেবে পরিচিত হয়।

১৮১০-এর দশকে তিনি ইতালিতে ছিলেন এবং প্যারিসে তাঁর কাজ কমই প্রদর্শিত হতো।

১৮২০-এর পর তিনি আবার ফ্রান্সে ফিরে আসেন।

১৮২৪ সালে তাঁর বিখ্যাত চিত্র “The Vow of Louis XIII” প্রকাশিত হয়।

এটি তাঁকে সরকারি স্বীকৃতি এনে দেয়।

একই বছর তিনি “Légion d’honneur” পদক পান।

এই কাজ তাঁকে নব্য-ধ্রুপদী ধারার মুখপাত্রে পরিণত করে।

রোমান্টিসিজমের প্রবল প্রভাব থাকা সত্ত্বেও তিনি ক্লাসিকাল শৈলী বজায় রাখেন।

তিনি বিশ্বাস করতেন শিল্পের উদ্দেশ্য হলো শৃঙ্খলা, সৌন্দর্য ও শুদ্ধতা প্রকাশ করা।

১৮৩০ সালে তিনি “Académie des Beaux-Arts”-এর সদস্য নির্বাচিত হন।

১৮৩৪ সালে তাঁর আরেকটি বিখ্যাত কাজ “The Martyrdom of Saint Symphorian” প্রদর্শিত হয়।

এই কাজ সমালোচকদের কাছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া পায়।

১৮৩৫ সালে তিনি আবার রোমে যান — এবার ফরাসি একাডেমির পরিচালক হিসেবে।

তিনি ১৮৪১ সাল পর্যন্ত এই পদে ছিলেন।

এই সময় তিনি তরুণ শিল্পীদের ক্লাসিক্যাল অনুশাসন শেখাতেন।

রোমে তিনি অত্যন্ত কঠোর শিক্ষক হিসেবে পরিচিত ছিলেন।

তাঁর ছাত্রদের মধ্যে অনেকেই পরে বিখ্যাত হন।

১৮৪৬ সালে তিনি প্যারিসে ফিরে আসেন।

তিনি প্রতিকৃতি চিত্রে নতুন উচ্চতা সৃষ্টি করেন।

তাঁর প্রতিকৃতি কাজগুলো সূক্ষ্ম রেখা ও মসৃণ রঙের জন্য বিখ্যাত।

তাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রতিকৃতি “Portrait of Madame Moitessier.”

এতে এক উচ্চবিত্ত নারীর মর্যাদাপূর্ণ সৌন্দর্য ফুটে উঠেছে।

আরেকটি বিখ্যাত কাজ “Portrait of Madame Rivière.”

তাঁর নারী প্রতিকৃতিগুলোতে এক ধরনের আদর্শীকৃত কোমলতা দেখা যায়।

১৮৫৬ সালে আঁকা “The Source” তাঁর শ্রেষ্ঠতম চিত্রগুলোর মধ্যে একটি।

এতে এক নগ্ন তরুণীকে ঝর্ণাধারার সঙ্গে একাত্ম করা হয়েছে।

এটি ক্লাসিকাল সৌন্দর্যের প্রতীক হিসেবে গণ্য হয়।

তিনি প্রায়শই চিত্রের মধ্যে সংগীত, কবিতা ও পুরাণের ছোঁয়া আনতেন।

অ্যাংগ্র ছিলেন রাফায়েলের উত্তরসূরি হিসেবে বিবেচিত।

তিনি মাইকেলেঞ্জেলোর তুলনায় রাফায়েলকে বেশি শ্রদ্ধা করতেন।

তাঁর শৈলীতে রেখার প্রাধান্য এবং রঙের সংযম লক্ষ্যণীয়।

তিনি বিশ্বাস করতেন সৌন্দর্য আদর্শের অনুসন্ধান থেকে আসে।

অ্যাংগ্র ইতিহাস, পৌরাণিক কাহিনি, প্রতিকৃতি ও নগ্ন চিত্রে পারদর্শী ছিলেন।

১৮৫৫ সালের প্যারিস এক্সপোজিশনে তাঁর অনেক কাজ প্রদর্শিত হয়।

সেখানে তিনি সর্বজনীন প্রশংসা লাভ করেন।

তাঁর ছাত্রদের মধ্যে ডেলাক্রোয়ার মতো রোমান্টিক শিল্পীদের প্রতিদ্বন্দ্বী দেখা যায়।

তবে অ্যাংগ্র নিজেকে রোমান্টিক আন্দোলনের বিরোধী বলতেন।

তাঁর মতে, শিল্পে আবেগ নয়, যুক্তি ও শৃঙ্খলা গুরুত্বপূর্ণ।

১৮৬২ সালে তাঁর স্ত্রী মাদেলিন শ্যাপেল মারা যান।

এই মৃত্যুর পর তিনি গভীরভাবে মর্মাহত হন।

জীবনের শেষ পর্যায়ে তিনি কম কাজ করতেন।

তিনি নিজের পুরনো কাজগুলো পুনরায় সংশোধন করতে ভালোবাসতেন।

১৮৬৭ সালে তিনি মারা যান।

মৃত্যুকালে তাঁর বয়স ছিল ৮৬ বছর।

মৃত্যুর স্থান ছিল প্যারিস, ফ্রান্স।

তাঁকে মনতবঁ শহরে সমাহিত করা হয়।

তাঁর মৃত্যুর পর ফ্রান্সে অ্যাংগ্রকে এক মহান ক্লাসিকাল চিত্রশিল্পী হিসেবে সম্মান জানানো হয়।

মনতবঁ শহরে তাঁর নামে Musée Ingres নামে একটি জাদুঘর প্রতিষ্ঠিত হয়।

সেখানে তাঁর শতাধিক মূল চিত্র সংরক্ষিত আছে।

তাঁর শিষ্য ও অনুসারীরা পরবর্তীকালে ক্লাসিকাল ধারাকে পুনরুজ্জীবিত করেন।

আধুনিক শিল্পে তাঁর প্রভাব রেখার বিশুদ্ধতায় দেখা যায়।

২০শ শতকে পিকাসোও তাঁর কাজ থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন।

“La Grande Odalisque” আধুনিক নারীত্বের প্রতীক হিসেবে আজও আলোচিত।

অ্যাংগ্র ছিলেন পরিমিতিবোধ ও শৃঙ্খলার শিল্পী।

তাঁর প্রতিটি চিত্রে আছে আকারের পরিপূর্ণ নিয়ন্ত্রণ।

তিনি বলেছিলেন — “Art demands discipline and purity.”

তাঁর কাজগুলিতে প্রাচীন গ্রীক ও রোমান ভাবধারার প্রভাব স্পষ্ট।

রেনেসাঁ যুগের আদর্শ ও ধ্রুপদী ভারসাম্য তাঁর ক্যানভাসে জীবন্ত হয়েছে।

তিনি একাধারে ঐতিহ্যবাহী ও উদ্ভাবনী ছিলেন।

আধুনিক সমালোচকরা তাঁকে “শেষ নব্য-ধ্রুপদী” বলে আখ্যা দেন।

তাঁর নারীচিত্রগুলোয় বাস্তবতা ও স্বপ্নের মিশ্রণ দেখা যায়।

অ্যাংগ্রের শিল্প ছিল রোমান্টিসিজমের বিপরীতে যুক্তির প্রকাশ।

তাঁর কাজ আজও লুভর মিউজিয়ামসহ ইউরোপের নানা জাদুঘরে প্রদর্শিত হয়।

অ্যাংগ্র ছিলেন সেই শিল্পী যিনি রেখাকে রঙের ওপরে স্থান দিয়েছিলেন।

তিনি ইতিহাসে স্মরণীয় নব্য-ধ্রুপদী যুগের শেষ ও সর্বাধিক নিখুঁত প্রতিনিধি।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top