Johannes Vermeer

Johannes Vermeer

ইওহানেস ভার্মিয়ার ছিলেন সপ্তদশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ডাচ চিত্রশিল্পী।

তাঁর জন্ম ১৬৩২ সালের অক্টোবর মাসে নেদারল্যান্ডসের ডেলফট শহরে।

পূর্ণ নাম ছিল Johannes Vermeer van Delft।

তাঁর বাবার নাম ছিল Reinier Janszoon, যিনি ছিলেন রেশম ব্যবসায়ী ও মদের দোকানদার।

মায়ের নাম Digna Baltens, যিনি ঘরের ব্যবসায় সহযোগিতা করতেন।

ভার্মিয়ার পরিবার আর্থিকভাবে মধ্যবিত্ত ছিল।

তিনি ১৬৫৩ সালে ডেলফট শহরের চিত্রশিল্পীদের গিল্ডে (Guild of Saint Luke) যোগ দেন।

একই বছর তিনি বিয়ে করেন Catharina Bolnes নামের এক তরুণীকে।

ক্যাথারিনা ছিলেন ধনী ক্যাথলিক পরিবারের মেয়ে।

ভার্মিয়ার নিজে প্রোটেস্ট্যান্ট পরিবারে জন্মালেও বিয়ের পর ক্যাথলিক ধর্ম গ্রহণ করেন।

তাঁদের মোট ১৫টি সন্তান ছিল, যার মধ্যে ১১টি বেঁচে ছিল।

তিনি সারা জীবন ডেলফট শহরেই বসবাস করেন।

ভার্মিয়ার তুলনামূলকভাবে অল্পসংখ্যক ছবি এঁকেছিলেন — মোট প্রায় ৩৪টি চিত্রকর্ম আজও টিকে আছে।

তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত চিত্রকর্ম হলো “Girl with a Pearl Earring”।

এই ছবিটি “উত্তরের মোনালিসা” নামেও পরিচিত।

তাঁর আরেকটি বিখ্যাত কাজ “The Milkmaid”।

তিনি “The Art of Painting” বা “The Allegory of Painting” নামের ছবিতেও খ্যাত।

“View of Delft” হলো তাঁর একমাত্র পরিচিত শহরদৃশ্যচিত্র।

ভার্মিয়ারের কাজের প্রধান বিষয় ছিল গৃহস্থালি জীবন ও নারীর নীরব মুহূর্ত।

তাঁর ছবিতে আলোর ব্যবহার অসাধারণ নিখুঁত।

তিনি প্রাকৃতিক আলোর সূক্ষ্ম পরিবর্তন ধরতে পারতেন অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে।

তাঁর চিত্রে দেখা যায় আলো জানালা দিয়ে প্রবেশ করছে, ঘরে পড়ছে, ছায়া তৈরি করছে।

এই আলোর বাস্তবতা তাকে অন্যান্য সমসাময়িক শিল্পীদের থেকে আলাদা করে।

ভার্মিয়ার ক্যামেরা অবস্কুরা (camera obscura) নামের অপটিক্যাল যন্ত্র ব্যবহার করেছিলেন বলে ধারণা আছে।

এই যন্ত্র তাঁকে আলোক-ছায়ার নিখুঁত অনুপাত বুঝতে সাহায্য করত।

তিনি অত্যন্ত ধীরগতিতে কাজ করতেন।

প্রতি বছর গড়ে এক থেকে দুইটি চিত্রই সম্পন্ন করতেন।

তাঁর রঙের ব্যবহার ছিল শান্ত, মৃদু ও প্রায় কবিতার মতো।

তিনি প্রায়ই নীল, হলুদ ও ধূসর রঙের সংমিশ্রণ ব্যবহার করতেন।

তাঁর ছবিতে দেখা যায় গৃহস্থালি সামগ্রী, জানালা, মানচিত্র, মেঝের টাইল, টেবিলের কাপড় ইত্যাদি।

ভার্মিয়ারের “Woman Holding a Balance” চিত্রে আলোর প্রতীকী অর্থ স্পষ্ট।

তিনি চিত্রে ভারসাম্য, নীরবতা ও আধ্যাত্মিক গভীরতা তৈরি করতেন।

তাঁর প্রতিটি চিত্র যেন স্থির, ধ্যানমগ্ন মুহূর্ত।

“The Lacemaker” চিত্রটি সূক্ষ্ম মনোযোগ ও নারীর কাজের সৌন্দর্য ফুটিয়ে তোলে।

“Girl Reading a Letter at an Open Window” আরেকটি বিখ্যাত কাজ।

এই চিত্রে চিঠি পড়া নারীর মুখে আলো পড়েছে জানালা দিয়ে।

এতে প্রেম, গোপনীয়তা ও মানবিক আবেগ প্রকাশ পেয়েছে।

ভার্মিয়ার কখনো যুদ্ধ, রাজনীতি বা ধর্মীয় সহিংসতা চিত্রিত করেননি।

তিনি ছিলেন নীরব, ব্যক্তিগত ও সংযত শিল্পী।

তাঁর সমসাময়িক ছিলেন Rembrandt ও Frans Hals, কিন্তু তাঁদের মতো জনপ্রিয় ছিলেন না জীবদ্দশায়।

ভার্মিয়ারের জীবদ্দশায় তাঁর কাজ খুব বেশি বিক্রি হয়নি।

জীবনের শেষদিকে তিনি তীব্র আর্থিক সংকটে পড়েন।

১৬৭২ সালে ফ্রান্স ও নেদারল্যান্ডসের যুদ্ধ (Rampjaar) অর্থনীতিতে বিপর্যয় আনে।

তাঁর চিত্র বিক্রি বন্ধ হয়ে যায়।

দেনা-পাওনার চাপে তিনি মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন।

১৬৭৫ সালের ডিসেম্বর মাসে তাঁর মৃত্যু হয়।

মৃত্যুর সময় তাঁর বয়স ছিল মাত্র ৪৩ বছর।

মৃত্যুর কারণ সম্ভবত মানসিক চাপ ও অপুষ্টিজনিত অসুস্থতা।

মৃত্যুর পর তাঁর পরিবার ভয়ানক ঋণে জর্জরিত হয়ে পড়ে।

তাঁর স্ত্রী ও সন্তানদের সম্পত্তি বিক্রি করতে হয়েছিল।

মৃত্যুর পর প্রায় ২০০ বছর তাঁর নাম প্রায় বিস্মৃত হয়ে যায়।

১৯শ শতাব্দীতে তাঁর পুনরাবিষ্কার ঘটে।

শিল্প সমালোচক Théophile Thoré-Bürger ভার্মিয়ারের চিত্র পুনরায় প্রচারে আনেন।

তখন তাঁর কাজ নতুন করে প্রশংসিত হতে শুরু করে।

তাঁর চিত্রের বাস্তবতা, আলো ও নীরব ভাবধারা নতুন প্রজন্মকে মুগ্ধ করে।

বর্তমানে তাঁর কাজ সারা বিশ্বের শ্রেষ্ঠ জাদুঘরগুলোতে সংরক্ষিত।

যেমন Mauritshuis (The Hague), Rijksmuseum (Amsterdam), Louvre (Paris), ও Metropolitan Museum (New York)।

“Girl with a Pearl Earring” বর্তমানে হেগের Mauritshuis-এ সংরক্ষিত।

তাঁর ছবির আকার সাধারণত ছোট, ঘরোয়া ও ব্যক্তিগত।

প্রতিটি চিত্রে সূক্ষ্ম জ্যামিতিক বিন্যাস রয়েছে।

তিনি দৃশ্যের পারস্পরিক দূরত্ব ও আলো ব্যবহার করে গভীরতা তৈরি করতেন।

প্রায় সব চিত্রেই জানালা বাম পাশে থাকে — এটি তাঁর পরিচিত স্টাইল।

তাঁর প্রিয় মডেল হিসেবে ধারণা করা হয় তাঁর স্ত্রী বা কন্যাদের ব্যবহার করেছেন।

তিনি নিজের কোনো আত্মপ্রতিকৃতি আঁকেননি।

তাঁর কাজে “নীরবতার সংগীত” বলা হয়।

তিনি বারোক যুগের শিল্পী হলেও তাঁর চিত্রে ক্লাসিক শান্তির ছোঁয়া আছে।

তাঁর রচনায় ডাচ সংস্কৃতির দৈনন্দিন সৌন্দর্য প্রকাশ পেয়েছে।

“The Music Lesson” চিত্রে শিক্ষাদান ও শিল্পের আভিজাত্য ফুটে উঠেছে।

“Officer and Laughing Girl” চিত্রে আলো ও ছায়ার বৈপরীত্য চমৎকার।

“The Geographer” চিত্রে বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান ও চিন্তাশীল মনোভাব ফুটে উঠেছে।

“The Astronomer” হলো এর সহচিত্র — সেখানে একই মডেল ব্যবহৃত হয়েছে বলে মনে করা হয়।

তাঁর কাজের নান্দনিকতা অনেক আধুনিক শিল্পীর ওপর প্রভাব ফেলেছে।

বিশেষ করে ফটোগ্রাফার ও সিনেমাটোগ্রাফাররা তাঁর আলোকচিত্রধর্মী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে প্রভাবিত।

ডেভিড হকনি তাঁর অপটিক্যাল কৌশল নিয়ে গবেষণা করেছেন।

২০০৩ সালে “Girl with a Pearl Earring” নামে তাঁর জীবনের ওপর একটি চলচ্চিত্র তৈরি হয়।

চলচ্চিত্রে ভার্মিয়ারের চরিত্রে অভিনয় করেন Colin Firth, এবং মডেলের ভূমিকায় ছিলেন Scarlett Johansson।

চলচ্চিত্রটি বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয়তা পায়।

আজকের দিনে ভার্মিয়ার হলেন বাস্তববাদ ও নীরব আবেগের প্রতীক।

তাঁর প্রতিটি চিত্র দর্শককে স্থিরতার দিকে টেনে নেয়।

তিনি প্রমাণ করেছেন, সাধারণ জীবনও চিত্রকলায় মহিমা পেতে পারে।

তাঁর কাজে গৃহিণীর নিত্যদিনের কাজ এক প্রকার ধ্যান হয়ে ওঠে।

আলো ও ছায়া তাঁর কাছে ছিল আধ্যাত্মিক রূপক।

তাঁর চিত্রে নারীর উপস্থিতি সর্বদা মর্যাদাপূর্ণ।

তাঁর ছবিতে কোনো অস্থিরতা বা কৃত্রিমতা নেই।

তিনি অল্প পরিসরে অসীম গভীরতা সৃষ্টি করতে পারতেন।

ভার্মিয়ার ছিলেন একজন নিখুঁত পরিপূর্ণতাবাদী।

তাঁর তুলিতে রঙের স্তরগুলো ছিল পাতলা, স্বচ্ছ ও সূক্ষ্মভাবে মিলিত।

কখনও কখনও তিনি মূল্যবান রঙ lapis lazuli (নীলকান্ত পাথরের গুঁড়ো) ব্যবহার করতেন।

এটি তখন অত্যন্ত ব্যয়বহুল ছিল।

তবুও তিনি এই নীল ব্যবহার করতেন আলোর গৌরব বোঝাতে।

তাঁর চিত্রে দর্শক যেন নীরবতা শুনতে পায়।

ভার্মিয়ারের কাজ প্রায়শই কবিতা বা সঙ্গীতের মতো অনুভূত হয়।

তিনি ছিলেন এক নিঃশব্দ প্রতিভা, যার মূল্য ইতিহাস পরে বুঝেছে।

বর্তমানে তাঁর প্রতিটি চিত্র কোটি কোটি ইউরো মূল্যের।

তাঁর চিত্রকর্মগুলি বিশ্বব্যাপী শিল্পপ্রেমীদের কাছে অমূল্য ধন।

ভার্মিয়ারের জীবন ছোট হলেও প্রভাব ছিল গভীর।

তিনি আলো ও বাস্তবতার ভাষাকে এক নতুন রূপ দিয়েছিলেন।

তিনি প্রমাণ করেছিলেন শিল্প মানে শুধু রঙ নয় — দৃষ্টি ও অনুভূতির সমন্বয়।

আজ তাঁর নাম বিশ্ব শিল্পের চিরন্তন তালিকায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা।

ইওহানেস ভার্মিয়ার আজও “আলোর কবি” হিসেবে স্মরণীয়।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top