জন এলিয়ট: আমেরিকার “অ্যাপোস্টল টু দ্য ইন্ডিয়ানস”—সমাজ, ভাষা ও ধর্মচেতনার এক অগ্রদূত

John Eliot

১৭শ শতাব্দীর নিউ ইংল্যান্ড ইতিহাসে জন এলিয়ট (John Eliot, ১৬০৪–১৬৯০) সেইসব ব্যক্তিত্বদের একজন, যাঁদের কাজ সময়ের স্রোতে বহমান থেকেও আজও বিস্ময় জাগায়। তিনি শুধু ধর্মপ্রচারক ছিলেন না; ছিলেন ভাষাবিদ, শিক্ষাবিদ, সামাজিক সংস্কারক এবং উপনিবেশ-ইউরোপীয় সম্পর্কের এক অনন্য সেতুবন্ধনকারী। আমেরিকার আদিবাসীদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ছিল গভীর মানবিক শ্রদ্ধা ও সংলাপের ফসল, যা শেষ পর্যন্ত “ইন্ডিয়ান বাইবেল” নামে পরিচিত বিশ্বের প্রথম সম্পূর্ণ আদিবাসী ভাষায় অনূদিত বাইবেল প্রকাশের দিকে নিয়ে যায়।

১. জন্ম, শিক্ষা ও আদর্শের বীজ

জন এলিয়টের জন্ম ১৬০৪ সালে ইংল্যান্ডের হার্টফোর্ডশায়ারের ওয়িডফোর্ডে। প্রাক্-পুরিতান ইউরোপের বাতাসে তখন সংস্কার আন্দোলনের ঝড় বইছে। তাঁর পরিবার ছিল ধর্মপ্রাণ, শিক্ষিত এবং সমাজে সুশৃঙ্খল মূল্যবোধের প্রতিনিধিত্বকারী। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের Jesus College-এ তিনি শিক্ষালাভ করেন—যেখানে কঠোর ধর্মতত্ত্ব, যুক্তিবিদ্যা ও ভাষাতত্ত্বের অনুশীলন তাঁর মানসিক গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

কেমব্রিজে পড়াকালীনই একজন শিক্ষক, থমাস হুকার, তাঁর উপর গভীর প্রভাব ফেলেন। ধর্মীয় স্বাধীনতার স্বপ্ন, নতুন পৃথিবীতে খ্রীষ্টীয় নৈতিকতার বিস্তার, এবং আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সঙ্গে ন্যায্য সম্পর্ক গড়ার আকাঙ্ক্ষা—এই তিনটি বীজ তখন থেকেই তাঁকে ভবিষ্যতের পথে ঠেলে দেয়।

২. নিউ ইংল্যান্ডে আগমন ও মিশনারি জীবনের শুরু

১৬৩১ সালে জন এলিয়ট পিউরিটানদের সঙ্গে আমেরিকার ম্যাসাচুসেটস উপনিবেশে পৌঁছান। নতুন পৃথিবী তখনও তরুণ, অস্থির, রাজনৈতিকভাবে উদ্বায়ী এবং সাংস্কৃতিকভাবে বহুমাত্রিক। চারদিকে অরণ্য, নদী, উপজাতীয় গ্রাম, এবং ইউরোপীয় বসতির ছড়াছড়ি। এই পরিবেশে এলিয়ট গড়ে তোলেন তাঁর জীবনব্যাপী মিশন।

তিনি রোক্সবারির First Church of Roxbury-র পুরোহিত হিসেবে নিযুক্ত হন। কিন্তু তাঁর মন ছিল আরও দূরে—আদিবাসীদের কাছে পৌঁছানো, তাদের ভাষা শেখা, তাদের সঙ্গে মানবিক সম্পর্ক তৈরি করা এবং ধর্মীয় শিক্ষার মাধ্যমে সামাজিক সংগঠন গড়ে তোলা।

৩. মাসাচুসেট ভাষার সন্ধান: ভাষাবিজ্ঞানীর নতুন দিগন্ত

জন এলিয়টের সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব হলো উত্তর আমেরিকার আদিবাসী ভাষাগুলোর মধ্যে অন্যতম Massachusett (Algonquian) ভাষা শেখা এবং সেই ভাষায় বিপুল পরিমাণ সাহিত্য রচনা। এই ভাষা ছিল মৌখিক; লিখিত কোন প্রথা ছিল না। এলিয়ট আদিবাসীদের সঙ্গে বসে বসে ভাষাটির ব্যাকরণ, ধ্বনি, শব্দগঠন, বাক্যপ্রকরণ সব কিছু লিপিবদ্ধ করেন।

৩.১ এলিয়টের ভাষাবিজ্ঞানী দৃষ্টিভঙ্গি

তিনি মনে করতেন, ভাষা শিখলে মানুষের মন বোঝা যায়।

ভাষা হলো সাংস্কৃতিক স্মৃতির বাহক—এটি ভেঙে ফেললে কোনো জাতিরই আত্মপরিচয় থাকে না।

তাই তিনি ভাষার অভ্যন্তরীণ সংগঠনকে যথাসম্ভব সম্মান দিয়েই লিখনপদ্ধতি তৈরি করেন।

এই শ্রমদীপ্ত প্রক্রিয়ার ফসল হলো ‘Indian Grammar Begun’ (১৬৬৬)—যা পরবর্তী ভাষাতত্ত্বীয় অধ্যয়নের ভিত্তি হয়ে ওঠে।

৪. আদিবাসীদের জন্য বাইবেল: “মমত্রাশ্তু”—বিশ্ব সাহিত্যে নজিরবিহীন এক উদ্যোগ

১৬৬৩ সালে জন এলিয়ট প্রকাশ করেন তাঁর শ্রেষ্ঠ কীর্তি—The Eliot Indian Bible। এটি ছিল আমেরিকার যে কোনো আদিবাসী ভাষায় প্রথম সম্পূর্ণ বাইবেল অনুবাদ। শুধু তাই নয়, যেকোনো উপনিবেশিক অঞ্চলে প্রাকৃতিকভাবে ভাষান্তরিত ধর্মগ্রন্থের মধ্যে এটি ছিল অগ্রগণ্যতম উদাহরণ।

৪.১ কেন এই অনুবাদ গুরুত্বপূর্ণ

একটি মৌখিক ভাষাকে লিখিত রূপে পরিণত করা

খ্রীষ্টধর্মের পাঠ সাহিত্যিক ও অন্তর্লীন সাংস্কৃতিক মূল্যবোধকে ভাষার আবহে স্থানান্তরিত করা

আদিবাসী সম্প্রদায়ের শিক্ষা আন্দোলনের গতিশীলতা সৃষ্টি করা

অনুবাদটি প্রকাশিত হয় Massachusett ভাষার ল্যাটিন বর্ণমালায় লেখা সংস্করণে। এর প্রথম শব্দ “Mamusse Wunneetupanatamwe Up-Biblum God”—যার অর্থ “ঈশ্বরের পবিত্র বই।”

ইতিহাসবিদরা আজও বলেন, এটি ছিল ভাষাগত সহিষ্ণুতা ও সাংস্কৃতিক সম্মানের এক নবতর অভিব্যক্তি।

৫. আদিবাসী বসতি ও সামাজিক সংগঠন: প্রেয়িং টাউন-এর ধারণা

জন এলিয়ট শুধু আদিবাসীদের কাছে খ্রীষ্টধর্ম পৌঁছে দেওয়া নিয়ে ভাবেননি; তিনি ভাবতেন সমাজ সংগঠনের মাধ্যমেও প্রতিরূপ তৈরি করার কথা।

তিনি প্রতিষ্ঠা করেন “Praying Towns”—অর্থাৎ খ্রীষ্টধর্মে দীক্ষিত আদিবাসীদের জন্য স্বশাসিত গ্রাম। এখানে:

শিক্ষা দেওয়া হতো

কৃষিশিক্ষা, হস্তশিল্প ও ন্যায়পরায়ণ জীবনের নিয়ম শেখানো হতো

আদিবাসী ভাষায় প্রচার চালানো হতো

স্থানীয় প্রশাসনের কাজে আদিবাসীরাই অংশ নিত

১৬৭৫ সালের মধ্যে প্রায় ১৪টি প্রেয়িং টাউন গড়ে ওঠে, যেখানে ৪০০০-এরও বেশি আদিবাসী বসবাস করতেন।

৬. কিং ফিলিপের যুদ্ধ: স্বপ্নের গ্রামে ঝড়

১৭শ শতকের নবতর পর্বে, ইউরোপীয় উপনিবেশ বিস্তারের সঙ্গে আদিবাসী-ইউরোপীয় সম্পর্কের সংকট ঘনীভূত হতে থাকে। ১৬৭৫ সালে King Philip’s War—উপনিবেশ ইতিহাসের অন্যতম ভয়াবহ সংঘাত—শুরু হয়।

এলিয়ট এই সংঘাতের বিরুদ্ধে ছিলেন। কিন্তু যুদ্ধের উত্তেজনায় উপনিবেশবাসীরা প্রেয়িং টাউনগুলিকে সন্দেহের চোখে দেখতে শুরু করে। অনেক আদিবাসীকে বন্দি করা হয়, অনেকে পালিয়ে যান, অনেকে নিহত হন। প্রেয়িং টাউনগুলোর সংগঠন প্রায় ভেঙে পড়ে।

জন এলিয়ট এই সময় দারুণভাবে ভেঙে পড়েছিলেন—তাঁর মানবিক প্রচেষ্টা যেন রাজনীতির ক্রুদ্ধ আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছিল। তবু তিনি ভরসা হারাননি। যুদ্ধ শেষে আবারো তিনি শিক্ষাকেন্দ্র, বিদ্যালয় এবং সামাজিক সংগঠন গড়ে তোলার কাজে মন দেন।

৭. শিক্ষা: এলিয়টের দীর্ঘস্থায়ী স্বপ্ন

এলিয়ট বিশ্বাস করতেন যে শিক্ষা কোনো জাতিকে তার শিকড় থেকে আলাদা না করে বরং সৃজনশীল উপায়ে উন্নতির পথ দেখায়। এজন্য তিনি:

ইংরেজি ও আদিবাসী ভাষার দ্বিভাষিক শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলেন

স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন

শিশুদের জন্য ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষার পুস্তিকা রচনা করেন

ইংরেজি শেখার সহজপাঠ তৈরি করেন

তাঁর প্রচেষ্টায় ১৬৪৭ সালের শিক্ষা আইন “Old Deluder Satan Act”–এর মাধ্যমে ম্যাসাচুসেটস-এ স্কুল প্রতিষ্ঠা বাধ্যতামূলক হয়। এই আইন আমেরিকার পাবলিক স্কুল ব্যবস্থার অন্যতম ভিত্তিস্তম্ভ।

৮. একজন মানবিক দূরদর্শীর মানসযাত্রা

জন এলিয়টের ধর্মপ্রচারক পরিচয় তাঁর একমাত্র পরিচয় নয়। তাঁর জীবনদর্শনে দেখা যায়:

৮.১ মানবিকতা

তিনি আদিবাসীদের “অন্য” হিসেবে দেখেননি। তাদের বুদ্ধিমত্তা, সামাজিক সংস্কৃতি, এবং ভাষাগত বৈশিষ্ট্যের প্রতি গভীর সম্মান দেখিয়েছেন।

৮.২ সমমর্যাদার ধারণা

তাঁর ভাষায়,
“They are God’s children, as much as any man born in England.”

এই ধারণা ১৭শ শতকের উপনিবেশিক চেতনার মধ্যে ছিল যথেষ্ট বিপ্লবী।

৮.৩ ন্যায়বোধ

তিনি অনেক সময় উপনিবেশিক প্রশাসনের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন, যখন তারা আদিবাসীদের প্রতি অনৈতিক আচরণ করেছে।

৯. পরবর্তী জীবন ও মৃত্যু

জন এলিয়ট দীর্ঘ ৮৫ বছরের দীর্ঘ জীবন কাটান, এবং তাঁর জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সক্রিয় ছিলেন। তিনি রোক্সবারিতে মৃত্যুবরণ করেন ১৬৯০ সালে।

শেষ বয়সে তিনি প্রায়ই বলতেন—যদি আবার জীবন পেতেন, তাহলে সমস্ত শ্রম আদিবাসীদের শিক্ষা ও ভাষা রক্ষার কাজে ব্যয় করতেন। তাঁর এই উক্তি আজও গবেষকদের আলোচনার কেন্দ্র।

১০. জন এলিয়টের উত্তরাধিকার

জন এলিয়টের কাজ ইতিহাসে যে কেন এত গুরুত্বপূর্ণ, তা কয়েকটি দিক থেকে বোঝা যায়—

১০.১ ভাষাগত উত্তরাধিকার

Massachusett ভাষা আজ আর দৈনন্দিন ভাষা হিসেবে ব্যবহৃত না হলেও এলিয়টের লিখনরীতির ওপর ভিত্তি করে এর পুনর্জাগরণ সম্ভব হয়েছে। আধুনিক ভাষাবিদ্যা, উপজাতিগত ভাষা গবেষণা ও আদিবাসী ভাষার পুনরুদ্ধার আন্দোলনে তাঁর কাজ অগ্রদূত।

১০.২ ধর্মীয় প্রচার ইতিহাসে স্থান

তিনি উপনিবেশিক যুগে ধর্মপ্রচারকে মানবিক শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক অনুবাদের সঙ্গে যুক্ত করেন—যা পরবর্তীকালে বিশ্বব্যাপী মিশনারি শিক্ষার নতুন ধারা তৈরি করে।

১০.৩ সামাজিক ন্যায় ও বহুসাংস্কৃতিক ভাবনা

একটি বহুভাষিক, বহু-সাংস্কৃতিক সমাজ যে ভবিষ্যতের পথ—এই ধারণা তিনি শতাব্দী আগে তুলে ধরেছিলেন।

১০.৪ প্রেয়িং টাউন-এর ধারণা

সমাজ সংগঠনের এই ধারণা পরবর্তীকালে নৃতত্ত্ববিদ, সমাজবিজ্ঞানী, এবং ইতিহাসবিদদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ একটি কেস স্টাডি হয়ে ওঠে।

১১. জন এলিয়ট: বিতর্ক ও সমালোচনার আলোচনাও

যদিও এলিয়টের কাজ মানবিকতার আলোয় ভাসে, কিছু সমালোচনাও রয়েছে—

সংস্কৃতিগত অভিযোজন: কেউ কেউ বলেন, তাঁর প্রচারকর্ম আদিবাসীদের সাংস্কৃতিক পরিচয়কে সংকুচিত করেছিল।

ধর্মীয় আধিপত্য: উপনিবেশিক যুগে খ্রীষ্টধর্ম বিস্তারের প্রচেষ্টা আজকের চোখে সাংস্কৃতিক আধিপত্যের অংশ মনে হতে পারে।

প্রেয়িং টাউন-এর বাস্তবতা: একে কেউ কেউ “ইউরোপীয় নিয়ন্ত্রণের কাঠামো” বলে বিশ্লেষণ করেন।

তবু ইতিহাসের বিচারে অনেক গবেষকই মনে করেন—এলিয়ট ছিলেন তাঁর সময়ের সীমাবদ্ধতার মধ্যেও অত্যন্ত উদারমনস্ক ও সহানুভূতিশীল মানুষ।

জন এলিয়ট—মানবিক অধ্যবসায়ের প্রতীক

জন এলিয়টের গল্প যেন এক দীর্ঘ জ্যোতির্ময় পথ—যেখানে ভাষার আলো, মানবিকতার উষ্ণতা, এবং শিক্ষা-সংস্কারের দৃঢ় স্বপ্ন মিলেমিশে এক বিস্ময়কর উত্তরাধিকার তৈরি করেছে।

১৭শ শতকে দাঁড়িয়ে এক ইউরোপীয় পুরোহিত যদি ভাবতে পারেন যে একটি আদিবাসী ভাষা শেখা এবং সেই ভাষায় বাইবেল অনুবাদ করা মানে সেই জাতির মানবিক মর্যাদাকে স্বীকৃতি দেওয়া—তবে আজকের পৃথিবীতে তাঁর কাজ আরও অনুরণিত হয়ে ওঠে।

জন এলিয়ট শুধু “Apostle to the Indians” নন; তিনি ছিলেন “বোঝাপড়ার দূত”—দুটি জগতকে পারস্পরিক সম্মান ও ভাষার সেতুর মাধ্যমে যুক্ত করার স্রষ্টা।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top