John Woolman: A Portrait of a Gentle, Radical Conscience
১৮ শতকের আমেরিকান আত্মিক ইতিহাসে জন উলম্যান এক স্বতন্ত্র ও স্বর্ণাভ আলো। তিনি ছিলেন কোয়াকার ধর্মীয় আন্দোলনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নৈতিক কণ্ঠ, একজন সাধু-স্বভাবের চিন্তক, সমাজসংস্কারক এবং মানবতার শুদ্ধতম আর্তির প্রতিভূ। তার লেখনী আড়ম্বরহীন, কিন্তু মানব-সমতার গভীরতম সত্যে নিবেদিত। তার The Journal of John Woolman—আমেরিকান সাহিত্যের প্রথমদিককার ক্লাসিক গ্রন্থগুলির মধ্যে একটি—আজও পাঠকদের এক শুচিশক্তির দিকে আমন্ত্রণ জানায়।
I. জন্ম ও পরিবেশ: শান্তির ঘরে বেড়ে ওঠা
জন উলম্যান জন্মগ্রহণ করেন ১৭২০ সালের ১৯ অক্টোবর, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউ জার্সির মাউন্ট হলিতে। তার পরিবার ছিল কোয়াকার ধর্মবিশ্বাসী—এক এমন ধর্মসম্প্রদায়, যারা আন্তরিকতা, নীরব প্রার্থনা, মানবসমতা, দাসপ্রথাবিরোধিতা এবং যুদ্ধবিরোধিতার পক্ষে সুস্পষ্টভাবে অবস্থান করত।
শিশু উলম্যান যে পরিবেশে বেড়ে ওঠেন, তা ছিল নিস্তব্ধতা, নৈতিকতা এবং সাধারণ মানুষের প্রতি সহানুভূতিতে ভরপুর। এই পরিবারিক আবহ থেকেই তার হৃদয়ে জন্ম নেয় মানবমর্যাদার প্রতি এক প্রগাঢ় সম্মান। কৈশোরে তিনি পিতার কৃষিজ কাজে সহায়তা করতেন; কখনো আবার দোকানে হাত লাগাতেন। ছোট থেকেই তিনি ছিলেন সংবেদনশীল, নীরব, গভীর চিন্তাশীল এবং পরোপকারী।
II. কৈশোরে মানবতার বীজ
উলম্যানের কিশোর বয়সেই ঘটে একটি অভিজ্ঞতা, যা তার জীবনদর্শনকে চিরতরে বদলে দেয়। একবার কাজের প্রয়োজনে তাকে একজন আফ্রিকান দাসকে বিক্রি করতে বলা হয়। নির্দেশ পালন করলেও তার অন্তরে জন্ম নেয় প্রবল অপরাধবোধ। তিনি অনুভব করেন—মানুষকে পণ্য হিসেবে বেচাকেনা করা এক অবর্ণনীয় অবিচার।
এই বেদনাবোধ থেকেই তার দাসপ্রথাবিরোধী আন্দোলনের সূচনা। মাত্র ষোল বছর বয়সেই তিনি বুঝে যান, ধর্মীয় ব্যাখ্যা বা অর্থনৈতিক লাভের আড়ালে মানবতার অপমানকে ঢেকে রাখা যায় না।
III. কোয়াকার ভাবধারার প্রভাব
কোয়াকাররা বিশ্বাস করতেন—
প্রত্যেক মানুষের মধ্যে ঈশ্বরের আলো আছে
কোন মানুষই অন্য মানুষের উপর প্রভুত্ব করতে পারে না
যুদ্ধ মানে মানবতার বিপর্যয়
নৈতিক সত্য কখনো আপস করতে শেখায় না
এই বিশ্বাসসমূহ উলম্যানের চিন্তার কেন্দ্রে বসে যায়। তার জীবন যেন এক শান্ত শিখা—কোলাহলহীন, তবু জরুরি ও দীপ্ত।
IV. দাসপ্রথার বিরুদ্ধে উলম্যানের সংগ্রাম
দাসপ্রথার বিরুদ্ধে সংগঠিত রাজনৈতিক আন্দোলন আমেরিকায় তখনও পুরোপুরি তৈরি হয়নি। কিন্তু উলম্যান বিষয়টি বুঝেছিলেন প্রায় আধ্যাত্মিক স্তরে। তিনি দাসমালিকদের কাছে যেতেন, নরম কণ্ঠে কথোপকথন করতেন, হৃদয়ে প্রশ্ন জাগিয়ে দিতেন—
“আপনি যাকে দাস বলছেন, তারও কি আপনার মতোই আলো নেই?”
তার পদ্ধতি ছিল কখনোই সংঘর্ষমূলক নয়। তিনি বিশ্বাস করতেন—মানুষের বিবেককে জাগিয়ে তুলতে হলে কণ্ঠস্বরে কঠোরতা নয়, সত্যের নীরব দীপ্তিই যথেষ্ট।
তার সময়কার কোয়াকার সমাজেও অনেকেই দাস রাখত। উলম্যান তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ভাষায় কথা বলেননি। বরং তিনি একে বলেছিলেন “the hidden wound of our society”। এইভাবে তিনি দাসপ্রথার নৈতিক অসঙ্গতিগুলো তুলে ধরে নিজের সম্প্রদায়ের মধ্যেই প্রথম এক শান্ত বিপ্লব ঘটান।
V. তার ভ্রমণ: সত্য প্রচারের পথ
১৭৪০-এর দশক থেকে ১৭৭২ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত উলম্যান নিরলস ভ্রমণ করেন—নিউ জার্সি, পেনসিলভানিয়া, ডেলাওয়ার, উত্তর ক্যারোলাইনা প্রভৃতি অঞ্চলে।
এই ভ্রমণগুলোর উদ্দেশ্য দু’টি—
সাধারণ মানুষের সাথে নৈতিক প্রশ্নে আলাপ
কোয়াকার সভায় বক্তৃতা করে সমাজের বিবেককে জাগানো
তিনি ঘোড়ায় চড়ে মাইলের পর মাইল যেতেন, কখনো খারাপ আবহাওয়ায়, কখনো ঝুঁকিপূর্ণ পথেও। কিন্তু তার লক্ষ্য ছিল নিরেট—মানুষের হৃদয়ে মানবতার শিকড়কে জাগিয়ে তোলা।
VI. অর্থনৈতিক নৈতিকতা: সরল জীবন, সৎ জীবন
উলম্যান শুধু দাসপ্রথার বিরুদ্ধে ছিলেন না; তিনি অর্থনৈতিক অসাম্য, শ্রমিকের শোষণ, অত্যধিক ভোগবাদ এবং অন্যায্য করনৈতিকতাকেও সমালোচনা করেন।
তিনি যে কয়েকটি নীতি মানতেন—
শ্রমের সঠিক মূল্য দেওয়া
বিলাসবহুল পোশাক এড়ানো
যে পণ্য উৎপাদনে দাসশ্রম ব্যবহৃত হয়, তা না কেনা
নিজের প্রয়োজন কমিয়ে রাখা
তার কথা ছিল—
“যে জিনিস আমাকে অন্য মানুষের পরিশ্রমকে অবমূল্যায়ন করতে বাধ্য করে, তা আমার আত্মার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা।”
অর্থনৈতিক নৈতিকতার এই ধারণা ছিল তখনকার আমেরিকার জন্য একেবারেই ব্যতিক্রমী। পরবর্তী শতকগুলোতে আমেরিকান সামাজিক-অর্থনৈতিক চিন্তায় এর প্রভাব ব্যাপক।
VII. যুদ্ধ ও সামরিক করের বিরুদ্ধে অবস্থান
কোয়াকাররা যুদ্ধবিরোধী, কিন্তু উলম্যান তাদের মধ্যে সবচেয়ে স্পষ্ট এবং যুক্তিপূর্ণ কণ্ঠ হয়ে ওঠেন। তিনি যুদ্ধের নৈতিক অমানবিকতা ব্যাখ্যা করেন—
যুদ্ধ মানে হত্যা, হত্যা মানে ঈশ্বরের আলোকে নির্বাসিত করা।
তাই তিনি সামরিক কর দিতে অস্বীকার করেছিলেন। কর কম না নিলে তিনি কখনো কখনো নিজের ঘরে করের পরিমাণ আলাদা করে রেখে দিতেন, যাতে নৈতিক আপত্তি প্রকাশ পায়।
VIII. উলম্যানের সাহিত্য: নীরব আলোর ভাষা
তার The Journal of John Woolman আমেরিকান আধ্যাত্মিক সাহিত্যের এক অনন্য প্রাচীন নিদর্শন।
এতে আমরা পাই—
তার ব্যক্তিগত নৈতিক সংগ্রাম
মানবতার প্রশ্নে তার অন্তর্দ্বন্দ্ব
দাসপ্রথা সম্পর্কে বিশ্লেষণ
আধুনিক সামাজিক ন্যায়বোধের আদি রূপ
গ্রন্থটির লেখনী সরল, যেন নদীর উপর দিয়ে নেমে আসা সকালের আলো—অহংকারহীন, তবে গভীর।
এর পাশাপাশি তার লেখা পত্র, প্রবন্ধ এবং দৈনন্দিন নথিপত্রও কোয়াকার সমাজে দাসপ্রথা বিলোপের পথ তৈরি করে।
IX. মৃত্যুর শেষ বর্ণিল আলো
১৭৭২ সালে দাসপ্রথার বিরুদ্ধে বক্তব্য প্রচারের জন্য তিনি ইংল্যান্ডে যান। সেখানেই এক মহামারীতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। শেষ মুহূর্তেও তার হৃদয়ে ছিল মানবতার প্রশ্ন। তার মৃত্যুর পর কোয়াকার সমাজে দাসপ্রথা-বিরোধী আন্দোলন দ্রুত তীব্র হয়।
অর্থাৎ উলম্যানের বপন করা বীজই একদিন পল্লবিত হয়ে ১৯ শতকের দাসপ্রথা-বিরোধী বৃহৎ আন্দোলনের ভিত হয়ে ওঠে।
X. উলম্যানের প্রভাব ও উত্তরাধিকার
উলম্যান কোনো বড় রাজনৈতিক নেতা ছিলেন না, কোনো সামাজিক বিপ্লবের সামরিক দিকনির্দেশকও নন। তবু তার প্রভাব অসীম—
কারণ তিনি মানুষের আত্মাকে স্পর্শ করতে জানতেন।
তার প্রভাবের প্রধান দিকগুলো হলো—
১. কোয়াকার সমাজে দাসমুক্তি
তিনি না থাকলে কোয়াকাররা এত দ্রুত এবং দৃঢ়ভাবে দাসপ্রথার বিরোধিতা করত না।
২. নৈতিক অর্থনীতি
তার সরল জীবনযাপন, ন্যায্য শ্রমমূল্য, দাসশ্রমবিরোধী বাণিজ্যবোধ আজও নৈতিক অর্থনীতির আলোচনায় গুরুত্বপূর্ণ।
৩. শান্তিবাদ
উলম্যানের যুদ্ধবিরোধী দর্শন ভবিষ্যৎ শান্তিবাদী আন্দোলনের ভিত্তি তৈরি করে।
৪. আমেরিকান সাহিত্য
তার Journal আমেরিকান সাহিত্যের প্রথম দিককার ক্লাসিক আধ্যাত্মিক আত্মজৈবনিক রচনা।
৫. নৈতিক মানবাধিকার ধারণা
তার যুক্তি ছিল মানবাধিকার কোনো সরকারি কাগুজে ধারণা নয়—এটি মানুষের আত্মার জন্মগত আলোক।
XI. উলম্যানের দর্শন: কিছু মূল ধারণা
১. অভ্যন্তরীণ আলো
প্রত্যেক মানুষের ভিতরেই ঈশ্বরীয় সত্যের আলো থাকে।
২. সমতা
কোনো মানুষই আরেক মানুষের উপর আধিপত্য করতে পারে না—জাতি, ধর্ম, অর্থ, শক্তি, কোনো ভিত্তিতেই নয়।
৩. সত্যের শক্তি
সত্য কখনো আঘাত হানতে চায় না; সে নরম কিন্তু দৃঢ়।
৪. নৈতিক ভোগ
যে ভোগ অন্যের শ্রমের অপমান তৈরি করে, তা অনৈতিক।
৫. নীরবতার মূল্য
নীরবতার মধ্যে মানুষ নিজের আত্মার কথা শুনতে পায়।
XII. আধুনিক প্রেক্ষাপটে উলম্যান
উলম্যানের নৈতিক প্রশ্নগুলো আজও তীক্ষ্ণ—
শ্রমবাজারে শোষণ কি শেষ হয়েছে?
দাসত্বের রূপ কি বদলে নতুন আকারে ফিরে আসেনি?
যুদ্ধ, বৈষম্য, অপচয়—এসব কি আমাদের সমাজে এখনো নেই?
উলম্যান যেন আমাদের অবিরাম মনে করিয়ে দেন—
মানুষের বিবেককে কখনো ঘুমিয়ে পড়তে দেওয়া যাবে না।
এক শান্ত বীজের অনন্ত ফলন
জন উলম্যান ছিলেন নীরবতার মানুষ, কিন্তু তার নীরবতার ভেতরে ছিল আকুল মানবধ্বনি। তার জীবন এক প্রার্থনা—
এ পৃথিবীতে যেন অন্যায় কমে, এবং মানুষের ভিতরকার আলো যেন জেগে ওঠে।
তার কাজ, তার চিন্তা, তার সরল কিন্তু অটল বিশ্বাস—সব মিলিয়ে তিনি মানবতার ইতিহাসে এক উজ্জ্বল ও কোমল কণ্ঠস্বর।
তিনি আমাদের শেখান—
বিপ্লব সবসময় ধ্বনি তোলে না; কখনো কখনো তা নিঃশব্দেই পৃথিবী বদলে দেয়।


















