বারান্দায় সবুজস্বপ্ন ও একজন বরকত আলী
নিজের বাড়ি না থাকলে, ভাড়া বাসায় গাছ লাগানোর যে ইচ্ছে, তা খুব কঠিন! রাজধানীর বুকে অনেকের এই শখ চোখে পড়ে, প্রায় প্রতিটি বাড়ি ঘেষেই রয়েছে ছোট বড় বেলকনির কালচার, অনেকের থাকে বিশাল ছাদ, কারও বা নিচতলা বাড়ির সামনে খোলা চত্বর, এক চিলতে রোদে সবুজের আকুলতা কারও মনকে নাড়া দেয়!
তবে;
সেই আক্ষেপে বেশি পুড়েন শহরের হতভাগা ভাড়াটিয়া শ্রেণীর মানুষ!
সব বাড়িওয়ালা-ই যে অন্যের মন-মানসিকতা সম্পর্কে ভাল ধারণা রাখবেন, তা ভুল, কেউ যে কারও সৃষ্টিশীলতাকে বাহবা দিবেন, সেই প্রত্যাশাও অনেক সময় কষ্টে ভুগায়!
আপনি-আমি ভাড়া থাকছি, এটা নিরাপদ আশ্রয়ের বিষয়, কিন্তু আপনার মন নামের যে স্বত্তা আপনাকে প্রকৃতির দিকে টেনে নিচ্ছে, তা কল্পনাপ্রসূত, মন ভাল রাখার আহ্বান।মানুষের সবুজ ভাল লাগে, প্রকৃতি ভাল লাগে, আর তাই- তো গাছ লাগাবে, ঘরকে হালকা একটু এডভেঞ্চার জীবনে নিয়ে আসতে চাইবে, তবেই না এক টুকরো সবুজ উদ্যানে পাখপাখালিরা’ও আপন প্রতিবেশী হয়ে মানুষের মাঝেই গড়ে তুলবে, সবুজবসতি! সে এক অন্যরকম জীবন। মানুষের সাথে সবুজের, সবুজের সাথে প্রকৃতির, মিলেমিশে টিকে থাকা।
কিন্তু;
বহুরূপী শহরের গল্প ভিন্ন।
অনেক সময় দেখা যায়, ভাড়াটিয়া বনাম বাড়িওয়ালার মধ্যে এসব নিয়ে শুরু হয় মতানৈক্য! ‘বাড়িওয়ালা’ খ্যাত মানুষটির কাছে ‘টারজান জীবন’ হয়ে পড়ে পুরোই তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের কারণ! এই দেশের কৃষ্টিতে দেখা যায়- ভাড়াটিয়ার স্বভাভ, ‘আমি টাকা দিয়ে থাকি, যা খুশি তাই করব, ‘অন্যের বাড়ি’ কথাটি মাথায় থাকে না। এই নীতিতে’ই মাসের পর মাস, কেউ বছরের পর বছর কাটিয়ে দেয় পরের বাড়ি…
আর বাড়িওয়ালা সাহেব?
উনি চিরাচরিত সিনেমার ভাষায়-একরোখা ভাড়াটিয়াকে বলছেন;
“সামনের মাসেই আমার বাসা খালি করবেন”।
এর ওপর তো আর কোন কথা নেই? ক্ষমতার দাপটের কাছে কখনও মানুষকে জেনেশুনেই পরাস্ত হতে হয়। সেজন্যই;
‘ভালো বাসা’ আর ‘ভালোবাসা’ দুটোই-এই শহরে পরিপূরক শব্দ। দুটোই বেঁচে থাকার জন্য শুধু না, শান্তিময় জীবনের জন্য খুব দরকারি। ইটপাথরের এই শহরে ভাগ্যক্রমে কারও বাড়িওয়ালা যদি প্রকৃতিপ্রেমী হন, তবেই কারও মনের ঘরে এক চিলতে সবুজ উদ্যান সম্ভব! আর এর ব্যতয় হলে, সব ‘অভিলাষ’ এক পসলা বৃষ্টির মতো ভেসে যাবে। ঠিক, বরকত সাহেবের মতন …
লোকটা;
৪ তলা, ৫ তলা, ৬ তলা, বা বহুতল ভবনে আপনি মাটি, টব কিংবা বড় বড় ড্রাম টেনে টুনে তুললেন, টাকাও খরচ করলেন বিস্তর! মনের সুখে অন্যের বাড়ি ভরে দিলেন সবুজছায়ায়…
উনার ভাষ্য;
‘অক্সিজেন কি শুধু আমার একার দরকার?’
মানুষটা সময়, টাকা পয়সা, শাররিক শ্রম, সব কিছুর বিনিময়ে প্রাণভরে ভাড়া বাড়িটিতে সবাইকে রোজঅক্সিজেন দিচ্ছেন। মহত কাজে নিজের’ও শান্তি! হলে কি হবে?
বিনামূল্যের অক্সিজেন প্রাপ্তীতে দেখা দিলো বিপত্তি! এতো বেশি পরিমাণ পরিস্কার বাতাস গিলে ফেলে একটা হূলস্থলকান্ড ঘটালেন,বরকত সাহেবের বেরসিক বাড়িওয়ালা! লোকটা পুরো’ই বেঁকে বসলেন-
“ এইটা আমার বাড়ি, কোন বনজঙ্গল না, এইখানে এসব চলবে না…”
বেচারা;
শহরের এই বাড়িটিতে অনেকদিন থেকেই ভাড়া থাকেন, বছরের পর বছর ধরে বড় তেলের বোতল কেটে, নানান জাতের ফলের চারা লাগিয়েছেন।
যা দিনকাল শুরু হয়েছে, ঢাকায় তো জমিজমা কেনা দুস্কর, ইচ্ছে আছে, গ্রামে এক টুকরো জমি যদি কপালে জুটে কখনও, তখন এই চারাগাছ নিয়ে নিজের জমিতে একদিন নিজের হাতে লাগাবেন। এই উপলক্ষে ৩ হাত লম্বা একটি সাবল কামারের দোকান থেকে অর্ডার করে বানিয়ে রেখেছেন! আসলে, সবুজের প্রবল আকর্ষণে খরচাপাতির ধারা কোনদিকে ছুটছে, কোন হুশ নেই! বেহুশ ভারাটে আর কটকটে বাড়িওয়ালা সাহেবের মধ্যে ইদানীং দেখা হলেও কেমন যেন উষ্ণ পরিবেশ সৃষ্টি হয়! এর কোন রহস্য ভেদ করতে পারেন না বরকত আলী। ভাড়াটের সৌখিনতাটুকু’ই লোকটার কাছে অনাচার ঠেকছে!
এই বেরসিক লোকটাকে কে বোঝাবে, মানুষটা বুঝতেই চায় না, ভাড়াটের বারান্দায় লাগানো এসব চারাগাছ নাকি ঘরবাড়ি সব শেষ করবে!
তা করতেই পারে;
কেননা, বাড়ির নাম কিনা, ‘স্বর্ণ মহল’!
সবুজায়ন নিয়ে পড়ে থাকা বরকত সাহেবের ঘর রীতিমতো একটি-রিসার্চজোন! প্রায় শতাধিক বিলুপ্তপ্রায় গাছ আছে ৩৮ ফিট লম্বা বারান্দায়। বছরের পর বছর ধরে একজন সবুজপ্রেমী’র বৃক্ষসংগ্রহশালা সাধারণ লোকের পক্ষে কোনকালে বোধগম্য হবে না। সেজন্যই তো যত দোষ এই সাদামনের মানুষটার! অত্যন্ত কষ্টের সংগ্রহ বাড়িতে এনে আপন হাতের পরশে গাছ সব বড় করছেন। বারান্দায় দাঁড়ালেই, সবুজ গাছের ছায়ায় প্রাণ জুড়ায় লোকটি।
ভাবছেন;
বাড়িওয়ালা দুলাল চৌধুরী বাসা ভাড়া দেয়ার সময় কিচ্ছুটি বললো না। এখন কেন হাম্বিতাম্বি করছে?
বারান্দাবাগান কি একদিনে হয়েছে। বরকত আলীর চোখে এখনও ভাসছে দিনগুলি…
মহানন্দে পুরো বারান্দাজুড়ে একটি বাগানবাড়ি! সবুজ বারান্দাকে সবুজ বন মনে হবে হঠাৎ! চোখ পড়তেই লোকে ১ মিনিট হলেও থমকে দাঁড়ান। ছোট বড় কত জাত বেজাতের লতা গুল্ম গাছের বাহার! সবুজাভ যে পরিবেশটা তৈরি হয়েছে, তা প্রকৃতি, পাখ-পাখালিকেও যেন অদ্ভুত আকর্ষণ করেছে। প্রজাপতি, নানান পাখি, সবাই এই বনবারান্দার প্রতিবেশী! খুব অল্প সময়ের মধ্যে ওদের সাথে মানুষটার এক ধরণের আত্মিক সম্পক গড়ে ওঠে! পাখিরা বারান্দায় নির্ভয়ে খড়কুটোয় ঘর করে,বাচ্চা দেয়, বরকত সাহেব খুশিতে পাখিদের আরও বেশি মাটির হাড়ি কিনে দেন। যেমনটি নিজের সন্তানের জন্য করেছেন…
দিনরাত কিচ মিচ কিচির মিচির সংগীতে সারা বাড়িতে বিধাতার পেয়ানোর সুর বাজে, মুর্ছনায় সারাদিনের অফিসের ক্লান্তি অবসাদ সব ভুলে যান স্থুলকার ভাড়াটে মানুষটা!
অথচ;
কর্কশ চৌধুরী সাহেব বরকত আলীর গড়া ‘ব্যবিলন’কে দুষছেন;
“আজাইরা সব গাছগাছালির কারণে পাখিরা দিনরাত ক্যাচক্যাচ করছে। বাড়িতে একটা মানুষ কি শান্তিতে ঘুমাতে পারে…”
দাপুটে বাড়িওয়ালা আর সহ্য করতে না পেরে, একদিন বলেই বসলেন;
‘’১২ দিন সময় দিলাম, বারান্দা খালি করেন…”
পাখির কলরব ভাল লাগে না, এমন মানুষও পৃথিবীতে বিরল!
একটা সামান্য ইস্যুর সাথে আরও বেশকিছু নিষেধাজ্ঞা জুড়ে দিয়ে চলে গেলেন দুলাল চৌধুরী।
১২ দিন সে ম্যালা সময়, ৩ দিনের মাথায় এত শখের সংগৃহীত গাছ সব মানুষকে ডেকে ডেকে বিনামূল্যে দিয়ে দিতে হবে?
বুকটা মোচর মারে বরকত আলীর, আজ নিজের এক টুকরো জমি থাকতো, গাছ সব একটা পিকাপ গাড়ি ভাড়া করে নিয়ে যাওয়া যেত। ৪ তলা থেকে ৮৪ বার নিচে নেমে নেমে, বুকের কাছে ধরেই, সবুজ গাছ সব নামিয়ে দিলেন মানুষটা!
৮৪ টি গাছ ঘন্টাখানিকের ভেতর নিচে নামানো হলো।
শরীর থেকে টুপটুপ ঘাম পড়ছে, হাত ও পায়ের মাসলস্ ব্যাথায় টনটন করছে, তবু;
“ইচ্ছেটাকে মরতে দেয়া যাবে না”…
৮০০ টাকায় ভ্যান ঠিক করে ৩ ট্রিপে সব গাছ নিয়ে গেলেন পাশের এক বিদ্যালয়ের মাঠে! খুব যত্নের সাথে সারিবদ্ধভাবে গাছগুলি রাখা হলো-
দপ্তরি অবাক!
স্কুলের অভিভাবক আজ এখানে গাছের মেলা বসালেন কেন, তিনি কি নার্সারির ব্যবসা করেন? বলেই বসলেন কাছে গিয়ে-
“গাছ বিক্রি করে মেয়েকে মানুষ করছেন বরকত ভাই?”
হাসলেন বরকত আলী;
“না তোতাভাই, এগুলো বিক্রি করব না, স্কুল ছুটির পর, সব বিনামূল্যে বিতরণ করে দিও।”
দপ্তরির বুকটা ভরে উঠলো। বৃক্ষপ্রেমি একজন মানুষ আজ নিজ চোখে দেখলেন। কত কি ভাবতে ভাবতে- তোতা মিয়া আজ ১০ মিনিট আগেই ছুটির ঘন্টা বাজিয়ে দিলো।
বাচ্চারা একটি করে সবুজ গাছ নিয়ে বাড়ি যাবে, দৃশ্যটা দেখার লোভ বিদ্যালয়ের দপ্তরিও কেন যেন ধরে রাখতে পারলেন না।
নিরবে দাঁড়িয়ে; বরকত আলী। দুর থেকে বিশেষ মুহূর্তটি নিজের মোবাইলে ধারণ করবেন বলে প্রস্তুত ছিলেন, কিন্তু চোখের কোনে দু’ফোটা আনন্দাশ্র’ থমকে দিলো, বরকত আলীর মনের পৃথিবীকে,
“এই পৃথিবী শুধু সবুজ আর সবুজ ঠেকছে কেন?”
শিশুরা কোলের ওপর একটি একটি চারা নিয়ে যাচ্ছে বাড়িতে, একটা ভরা কন্ঠের চিৎকার শোনা গেল;
“শিশুদের সাথে সবুজের পরিচয় ঘটে গেল মনে হয়?”
তবু হাত ঘষে চোখ মুছে মানুষটা, একজন পাগলাটে বরকত আলীর জীবনে এর চেয়ে বড় পুরস্কার আর কিছু নেই …
লেখক: মারুফ আহমেদ, ঢাকা।
০২.১২.২০২৫
পরিচিতি:
সাংবাদিক, কথাসাহিত্যিক ও নির্মাতা।





















শুভেচ্ছা । অভিনন্দন ।