ইসলামী সভ্যতা এবং ইউরোপের পুনর্জাগরণ

ইউরোপ এবং পশ্চিমা জ্ঞান-বিকাশের ইতিহাস সাধারণত গ্রিক ও রোমান পণ্ডিতদের অবদানের স্বীকৃতি দিয়ে শুরু হয়, যা প্রায় খ্রিস্টীয় ৩০০ সাল পর্যন্ত বিস্তৃত। এরপর দীর্ঘ নীরবতা ভেঙে আলোচনার সূত্রপাত ঘটে খ্রিস্টীয় ১৫০০ সালের পুনর্জাগরণ যুগ থেকে। এই মাঝের সময়কাল, অর্থাৎ ৩০০–১৫০০ সাল পর্যন্ত, সামাজিক, রাজনৈতিক বা বৈজ্ঞানিক অগ্রগতির ইতিহাসে প্রায় অনুল্লিখিত রয়ে গেছে। ইতিহাসবিদ মরোভিটজ এই দীর্ঘ সময়কে আখ্যা দিয়েছেন “ইতিহাসের কৃষ্ণগহ্বর” হিসেবে—যেন পুনর্জাগরণ একটি “ফিনিক্স” পাখির মতো সেই ছাই থেকে উঠে এসেছে, যা হাজার বছর ধরে নিভু নিভু করে জ্বলছিল গ্রিক-রোমান জ্ঞানের শেষ আলোকচ্ছটিতে।

বাস্তব চিত্র ছিল ভিন্ন। ৭০০ থেকে ১৫০০ সাল পর্যন্ত ইসলামী জগতে শিল্প, সাহিত্য, বিজ্ঞান এবং দর্শনের ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব অগ্রগতি সাধিত হয়। মুসলিম পণ্ডিতরা গ্রিক ও রোমানদের জ্ঞান গ্রহণ করে তা আরবিতে অনুবাদ করেন, সংরক্ষণ করেন, গভীরভাবে বিশ্লেষণ করেন এবং উন্নত করে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের হাতে তুলে দেন। এভাবেই তারা ইউরোপের পুনর্জাগরণের ভিত্তি স্থাপন করেন।

সেই সময় ইউরোপে বৈজ্ঞানিক, চিকিৎসা ও শিক্ষাবিষয়ক চর্চা প্রায় এক সহস্রাব্দ ধরে স্থবির ছিল। এর প্রধান কারণ ছিল ধর্মীয় কূপমণ্ডূকতা এবং গির্জার দ্বারা চাপানো বুদ্ধিবিরোধী মতবাদ। গ্রিক ও রোমান চিন্তাবিদদের বহু গুরুত্বপূর্ণ কাজ অপ্রচলিত ছিল। খ্রিস্টীয় ৩৯০ সালে আলেক্সান্দ্রিয়ার মহান গ্রন্থাগারের ধ্বংস সেই জ্ঞানের ভাণ্ডার হারানোর এক মর্মান্তিক ঘটনা।

মুসলিম জ্ঞানীরা শুধু প্রাচীন ঐতিহ্য সংরক্ষণ করেননি, বরং নিজেদের মৌলিক গবেষণা ও চিন্তার মাধ্যমে তা আরও সমৃদ্ধ করেছেন। দার্শনিকতা, জ্যোতির্বিজ্ঞান, ইতিহাস, গণিত, রসায়ন ও চিকিৎসাবিজ্ঞানের মতো নানা শাখায় তারা নতুন জ্ঞানের ঝর্ণাধারা সৃষ্টি করেছেন। তাঁদের গবেষণা শুধুমাত্র মুসলিম জগতেই নয়, বিশ্বব্যাপী বৈজ্ঞানিক উৎকর্ষের প্রতীক। এটি প্রমাণ করে যে বিজ্ঞান, দর্শন ও ধর্মতত্ত্ব পরস্পরের পরিপূরক হতে পারে। ইসলাম একটি ঐক্যবদ্ধ দর্শনের প্রতিনিধি, যেখানে সত্য বিশ্বাস ও পরীক্ষিত বিজ্ঞান একে অপরের পরিপূরক।

আরব মুসলিমরা শূন্যের ধারণা ভারতে থেকে গ্রহণ করে তা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেন। লিওনার্দো দা ভিঞ্চি আরবি সংখ্যা পদ্ধতি অধ্যয়ন করে তা ইউরোপে পরিচিত করেন। অ্যালগরিদম (মূল শব্দ “আল-গরিজম”) উদ্ভাবন করেন নবম শতকের পণ্ডিত আল-খাওয়ারিজমি। ত্রিকোণমিতি বিকাশ করেন আবু আল-ওয়াফা। ইবন আল-হাইসাম আলোকবিজ্ঞানে নতুন মাত্রা যোগ করেন—তিনি প্রমাণ করেন কিভাবে আলো চোখে প্রবেশ করে এবং অপটিক বিভ্রম, দ্বিনেত্রদৃষ্টি, মরীচিকা, রংধনু ও হ্যালোর মতো বিষয় নিয়ে গবেষণা করেন। জাবির ইবন হায়্যান অষ্টম শতকে সালফিউরিক অ্যাসিড প্রস্তুত করেন এবং রাসায়নিক পদার্থ শ্রেণিবদ্ধ করেন।

কাগজ প্রস্তুত প্রযুক্তি মুসলিমদের মাধ্যমে নবম শতকে মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে, যার ফলে বই প্রকাশের পরিসর বৃদ্ধি পায়। খ্যাতনামা পণ্ডিত ইবন খালদুন সমাজবিজ্ঞানের জনক হিসেবে পরিচিত। সিসিলিতে বসবাসকারী আল-ইদ্রিসি ইউরোপের মধ্যযুগীয় ইতিহাস ও ভূগোল বিষয়ক একটি বিখ্যাত গ্রন্থ রচনা করেন, যাতে ৭০টি মানচিত্র সংকলন করা হয়েছে। ভ্রমণকারী ও ইতিহাসবিদ আল-বিরুনি ও ইবন বতুতা তাঁদের ভ্রমণ ও গবেষণার মাধ্যমে ইতিহাস ও ভূগোলে অসামান্য অবদান রেখেছেন।

মুসলিমদের হাসপাতাল ইউরোপীয় হাসপাতালের তুলনায় বহু শতাব্দী এগিয়ে ছিল। শিক্ষাদান পদ্ধতিতে তারা অত্যন্ত প্রভাবশালী ছিল, বিশেষ করে হাসপাতালের ওয়ার্ডে শিক্ষার্থীদের সরাসরি প্রশিক্ষণ দেওয়ার প্রথা—যা পরবর্তীকালে সালার্নোর মেডিকেল স্কুল থেকে শুরু করে কানাডা, ব্রিটেন এবং আমেরিকায় জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এই আরব শিক্ষণপ্রণালী আজও পাশ্চাত্য চিকিৎসা শিক্ষায় প্রয়োগ করা হয়।

চিকিৎসাবিজ্ঞানে দামেস্কের ইবন আল-নাফিস রক্ত সঞ্চালনের ব্যাখ্যা দেন, যা উইলিয়াম হার্ভারের আবিষ্কারের তিন শতাব্দী পূর্বে। আল-রাজি হাম ও গুটিবসন্তের পার্থক্য নির্ধারণ করেন; আত-তাবারি প্রথম বুঝতে পারেন যে যক্ষ্মা একটি সংক্রামক রোগ। স্পেনে আল-জাহরাওয়ি শল্যচিকিৎসায় নানা যন্ত্র উদ্ভাবন করেন এবং ছানি অপসারণসহ জটিল অস্ত্রোপচার দক্ষতার সঙ্গে সম্পন্ন করেন। ইবন জুহর সূচ-সুতো ব্যবহার করে ক্ষত সেলাই প্রথা শুরু করেন।

ওষুধবিদ্যায় মুসলিম চিকিৎসকেরা দীর্ঘস্থায়ী ও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। তারা শুধু বহু ভেষজ ওষুধ আবিষ্কার করেননি, বরং রাসায়নিক নিষ্কাশনের আধুনিক প্রযুক্তি—যেমন পরিস্রবণ (filtration), পাতন (distillation) ও স্ফটিকীকরণ (crystallization)—কে পরিপক্ব ও কার্যকর করে তোলেন।

সতেরো শতকের ইংল্যান্ডে, ওষুধবিজ্ঞান শৃঙ্খলিত করার একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রয়াস ছিল The Pharmacopoeia of the London College of Physicians (১৬১৮), যেখানে হিপোক্রেটিস, গ্যালেন, ইবন সিনা (আভিসেন্না) ও মেসুয়ে (ইবন জাকারিয়া বিন মাসাওয়াহ) প্রমুখ প্রখ্যাত চিকিৎসকদের প্রতিকৃতি চিত্রায়িত করা হয়েছে। মুসলিম চিকিৎসকেরা প্রাচীন চিকিৎসাবিষয়ক পাঠ্যপুস্তক রচনায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন, যা গ্রিক পাণ্ডিত্য ও নতুন বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের সমন্বয়ে গঠিত।

মধ্যযুগে ইউরোপ ‘অন্ধকার যুগ’-এর আবরণে থাকলেও মুসলিম বিজ্ঞানী ও পণ্ডিতেরা ইউরোপে বিজ্ঞানের আলো ছড়িয়েছিলেন। খ্রিস্টীয় সপ্তম থেকে পঞ্চদশ শতাব্দীর মধ্যে (৭০০–১৫০০), মুসলিম জ্ঞানীরা বৈজ্ঞানিক অগ্রগতির মূল চালিকাশক্তি ছিলেন। তাঁদের গবেষণা ও আবিষ্কার মানবসভ্যতার ইতিহাসে গভীর ছাপ রেখেছে।

জন উইলিয়াম ড্রেপার তার গ্রন্থ “ History of the intellectual Development of Europe ” এ বলেন—

“ Not one of the purely mathematical, mixed or practical science omitted by Arabs “
—vol 1- page 325.

“ এমন কোন গাণিতিক, জটিল অথবা প্রায়োগিক বিজ্ঞান নেই যা মুসলমানরা বিশুদ্ধভাবে সমাধান করেনি”।

রবার্ট ব্রিফল্ট আরো জোরলোভাবে উল্লেখ করেন—

“ Science is the most momentous contribution of Arabs civilization to the modern World. The debt of our science to the Arabs does not consist in startling discoveries or revolutionary theories – science owes a great deal more to Arab culture… it owes its existence.. “
—page 190.

‘বিজ্ঞানে আমরা আরব মুসলিমদের কাছে শুধু এ জন্য ঋণী নয় যে, তারা আমাদের বিপ্লবী ধারণা ও সৃজনশীলতা উপহার দিয়েছে; বরং বিজ্ঞানের উত্থানে আরব কালচার ও বেশ প্রভাব রেখেছে। এক কথায়, বিজ্ঞানের অস্তিত্বই আরবদের থেকে….এটাও স্বতঃসিদ্ধ যে, আধুনিক শিল্প-সভ্যতার সূচনাতেও এ আরবদেরই অবদান।’

পন্ডিত জওহেরুল নেহেরু ব্রিফল্টের এই দাবিকে ‘ Glimpse of World history ‘ গ্রন্থে আরো জোরলোভাবে ব্যাক্ত করেন—

“ Among the ancients we do not find the scientific method in Egypt or China or India. We just find a bit of it in Greece. In roman again it was absent. But the Arabs had this scientific spirit of inquiry, and so they may be considered the fathers of Modern science “
—page 175.

“মিসর, চায়না কিংবা ভারতে যে সব প্রাচীন সভ্যতাগুলো গড়ে উঠে আমরা তাতে কোন বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি দেখতে পায়না। এর কিছুটা দেখতে পাই গ্রীক সভ্যতায়। তা আবার রোমান সভ্যতায় অনুপস্থিত। তবে আরবদের সেই বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধিৎসু মনোভাব ছিল। তাই তাদেরকে আধুনিক বিজ্ঞানের জনক হিসাবে অবহিত করা যেতে পারে ”।

অপরদিকে বময়ার্থ স্মিথ ‘Mohammad and Mohammadinism’ গ্রন্থে সাহসী কন্ঠে বলেন—
“ during the darkest period of European history for five hundreds years, held up the torch of learning to humanity ’’
—page 7.

‘ অর্থ্যাৎ, দীর্ঘ পাঁচশত বৎসর ইউরোপের যুগসন্ধির অন্ধকার যুগে মুসলিমরাই মানবজাতির দিকে শিক্ষার মশাল উঁচিয়ে ধরেছিল ’।

সুতরাং বলা যায়, মধ্যযুগে মুসলিম পণ্ডিতরা শুধু প্রাচীন জ্ঞান সংরক্ষণ করেননি, বরং নতুন উদ্ভাবন ও বৈজ্ঞানিক অগ্রগতির মাধ্যমে ইউরোপীয় পুনর্জাগরণের ভিত্তি স্থাপন করেছেন। তাঁদের অবদান মানবসভ্যতার ইতিহাসে চিরকাল স্মরণীয় হয়ে থাকবে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top