Michelangelo Buonarroti

মাইকেলেঞ্জেলো বুয়োনারোত্তি (Michelangelo di Lodovico Buonarroti Simoni) জন্মগ্রহণ করেন ৬ মার্চ, ১৪৭৫ সালে।

তাঁর জন্মস্থান ছিল ইতালির কাপনিসে (Caprese), তাসকানির কাছে।

তিনি ছিলেন রেনেসাঁ যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিল্পী, ভাস্কর, স্থপতি ও কবি।

মাইকেলেঞ্জেলোর পরিবার ছিল মধ্যবিত্ত কিন্তু সম্ভ্রান্ত বংশের।

তাঁর পিতা লোদোভিকো বুয়োনারোত্তি ছিলেন ফ্লোরেন্স সরকারের একজন ছোটখাটো কর্মকর্তা।

শৈশবে মাইকেলেঞ্জেলোর মা অল্প বয়সেই মারা যান।

তিনি ছোটবেলা থেকেই শিল্পকলার প্রতি আকৃষ্ট ছিলেন।

পরিবার তাঁর শিল্পচর্চাকে প্রথমে সমর্থন করেনি।

তবুও ১৩ বছর বয়সে তিনি শিল্পী দোমেনিকো গিরলান্দাইও (Domenico Ghirlandaio)-এর কাছে প্রশিক্ষণ নেন।

সেখানে তিনি ফ্রেস্কো চিত্রকলার কৌশল শিখেছিলেন।

খুব অল্প বয়সেই তাঁর প্রতিভা স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

পরে তিনি লরেঞ্জো দে’ মেডিচি (Lorenzo de’ Medici)-এর পৃষ্ঠপোষকতায় কাজ শুরু করেন।

মেডিচি পরিবারের “বাগান স্কুলে” তিনি প্রাচীন ভাস্কর্য অধ্যয়ন করেন।

এই সময় তিনি মানবদেহের গঠন ও সৌন্দর্যের উপর গভীর গবেষণা শুরু করেন।

তাঁর প্রথম বিখ্যাত ভাস্কর্য ছিল “মাদোনা অফ দ্য স্টেয়ার্স”।

এরপরের কাজ “Battle of the Centaurs”-ও ব্যাপক প্রশংসা পায়।

১৪৯৬ সালে তিনি রোমে যান।

সেখানে তিনি তাঁর শ্রেষ্ঠ প্রাথমিক সৃষ্টি “Pietà” নির্মাণ করেন।

এই ভাস্কর্যে মেরি ও মৃত যীশুর দেহের অসাধারণ বাস্তবচিত্র দেখা যায়।

“Pietà” বর্তমানে ভ্যাটিকান সিটির সেন্ট পিটার্স ব্যাসিলিকায় সংরক্ষিত।

মাইকেলেঞ্জেলো একমাত্র শিল্পী যিনি নিজের নাম ওই ভাস্কর্যে খোদাই করেছিলেন।

তাঁর আরেকটি শ্রেষ্ঠ ভাস্কর্য হলো “David”।

এটি মানবশরীরের সৌন্দর্য ও সাহসের প্রতীক।

“David” ভাস্কর্যটি ফ্লোরেন্সের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত।

এর উচ্চতা প্রায় ১৭ ফুট।

মার্বেল পাথরে এই ভাস্কর্যটি তৈরি হয় ১৫০১–১৫০৪ সালের মধ্যে।

ডেভিডের চোখের দৃঢ় দৃষ্টি মাইকেলেঞ্জেলোর মানবিক বাস্তবতার প্রকাশ।

তিনি ছিলেন অত্যন্ত কঠোর পরিশ্রমী ও একগুঁয়ে।

মাইকেলেঞ্জেলো তেলচিত্র পছন্দ করতেন না।

তবুও পোপ জুলিয়াস দ্বিতীয়ের আদেশে তিনি সিস্টিন চ্যাপেলের ছাদে চিত্র অঙ্কন করেন।

এই কাজ শুরু হয় ১৫০৮ সালে।

এবং শেষ হয় ১৫১২ সালে।

প্রায় চার বছর ধরে তিনি একা কাজটি সম্পন্ন করেন।

এতে ৩০০-রও বেশি মানবচিত্র অঙ্কিত হয়েছে।

চিত্রের মূল থিম ছিল “জেনেসিস” — বাইবেলের সৃষ্টি অধ্যায়।

সবচেয়ে বিখ্যাত দৃশ্য হলো “The Creation of Adam”।

এতে ঈশ্বরের আঙুল থেকে আদমের আঙুলে জীবনের সঞ্চার দেখানো হয়েছে।

এই চিত্র পশ্চিমা শিল্পের প্রতীক হয়ে গেছে।

সিস্টিন চ্যাপেলের ছাদচিত্র রেনেসাঁ শিল্পের শীর্ষ নিদর্শন।

তিনি স্থাপত্যবিদ হিসেবেও অনন্য ছিলেন।

১৫৪৬ সালে তাঁকে সেন্ট পিটার্স ব্যাসিলিকার প্রধান স্থপতি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়।

তাঁর নকশায় গম্বুজের রূপরেখা আজও অনুসৃত।

তিনি Laurentian Library-এর স্থাপত্য নকশাও করেন।

ফ্লোরেন্সে Medici Chapel তাঁর আরেক বিখ্যাত স্থাপত্যকর্ম।

তিনি ভাস্কর্য ও স্থাপত্যে মানব-আত্মার গভীরতা প্রকাশ করেছেন।

মাইকেলেঞ্জেলো ছিলেন কবিও।

তাঁর ৩০০-রও বেশি সনেট ও মাদ্রিগাল সংরক্ষিত আছে।

তাঁর কবিতায় প্রেম, আধ্যাত্মিকতা ও শিল্পদর্শন প্রতিফলিত হয়েছে।

তিনি নিজের জীবন সম্পর্কে প্রায়ই আত্মবিশ্লেষণ করতেন।

তিনি কখনও বিয়ে করেননি।

জীবনের বেশিরভাগ সময় তিনি একাকী থেকেছেন।

তিনি নিজের কাজের প্রতি ধর্মীয় দায়িত্ববোধ অনুভব করতেন।

তাঁর ধর্মবিশ্বাস গভীর হলেও শিল্পে মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রধান ছিল।

তিনি বিশ্বাস করতেন সৌন্দর্য ঈশ্বরের প্রতিফলন।

মাইকেলেঞ্জেলো বহু রাজা ও পোপের অধীনে কাজ করেছেন।

কিন্তু তিনি কর্তৃত্ব পছন্দ করতেন না।

পোপ জুলিয়াস দ্বিতীয়ের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ছিল জটিল।

অনেক সময় তিনি রাগের বশে কাজ ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন।

তবুও তাঁর প্রতিভা তাঁকে আবার ফিরিয়ে আনত।

তিনি নিজের কাজের ক্ষেত্রে নিখুঁততা চেয়েছিলেন।

তাঁর সহকারী খুব কম ছিল, কারণ তিনি একা কাজ করতে পছন্দ করতেন।

তিনি মার্বেলের ভিতরে রূপ খুঁজে বের করতেন — “sculpture is already there, I just release it।”

তাঁর কাজের গভীরে মানবদেহের বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ ছিল।

তিনি মৃতদেহ অধ্যয়ন করতেন শরীরবিজ্ঞান বোঝার জন্য।

এই জ্ঞান তাঁর ভাস্কর্যে জীবন্ততা এনে দেয়।

তিনি ফ্লোরেন্সের “Accademia delle Arti del Disegno”–এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন।

মাইকেলেঞ্জেলো ছিলেন লিওনার্দো দা ভিঞ্চির সমসাময়িক।

দুজনের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল।

তাঁরা একে অপরের শিল্পদক্ষতাকে শ্রদ্ধা করলেও অহংকারে সংঘর্ষ ঘটত।

মাইকেলেঞ্জেলোর শিল্পে শক্তি ও অভিব্যক্তি প্রধান।

তিনি মানবদেহের মাধ্যমে আত্মার শক্তি প্রকাশ করেছেন।

তাঁর “The Last Judgment” ফ্রেস্কো একটি বিশাল সৃষ্টিকর্ম।

এটি সিস্টিন চ্যাপেলের বেদিপিঠের দেয়ালে আঁকা হয়।

কাজটি সম্পন্ন হয় ১৫৪১ সালে।

এতে যীশুর বিচারদিবসের দৃশ্য ফুটে উঠেছে।

এটি প্রায় ৪৬০ বর্গমিটার জায়গা জুড়ে আঁকা হয়।

এতে নগ্ন মানবচিত্রের কারণে তৎকালীন চার্চ সমালোচনা করেছিল।

পরে কিছু অংশ ঢাকা দেওয়া হয়, যা “fig-leaf campaign” নামে পরিচিত।

মাইকেলেঞ্জেলোর শিল্পে আলো-ছায়ার নাটকীয়তা ছিল অনন্য।

তাঁর শৈলী পরবর্তীকালে ম্যানারিজম (Mannerism) আন্দোলনের সূচনা করে।

তিনি তাঁর সমসাময়িকদের প্রভাবিত করেছিলেন — যেমন রাফায়েল, দা ভিঞ্চি প্রমুখ।

তিনি নিজের জীবনে অত্যন্ত সংযমী ছিলেন।

তিনি সাধারণ পোশাক পরতেন এবং প্রায়ই মাটিতে ঘুমাতেন।

তাঁর ব্যক্তিগত জীবন ছিল শিল্পে নিবেদিত।

মাইকেলেঞ্জেলো কখনও ধনী হতে চাননি, কিন্তু তিনি সম্পদশালী হয়েছিলেন।

তিনি বহু পোপের কাছ থেকে কমিশন পেয়েছিলেন।

তবুও তিনি স্বাধীনতার মূল্য বুঝতেন।

তিনি বহুবার বলেছিলেন: “আমার আত্মা মার্বেলের ভিতর বন্দী।”

জীবনের শেষ দিকে তিনি রোমে স্থায়ী হন।

সেখানে তিনি সেন্ট পিটার্স ব্যাসিলিকার গম্বুজের কাজ চালিয়ে যান।

জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তিনি কাজ করতেন।

তিনি মৃত্যুবরণ করেন ১৮ ফেব্রুয়ারি, ১৫৬৪ সালে।

তখন তাঁর বয়স ছিল ৮৮ বছর।

মৃত্যুর আগে তিনি ধর্মীয় ও দার্শনিক চিন্তায় ডুবে ছিলেন।

তাঁর দেহ ফ্লোরেন্সে ফিরিয়ে আনা হয়।

তাঁকে সমাধিস্থ করা হয় Basilica di Santa Croce–তে।

তাঁর নাম আজও “দ্য ডিভাইন মাইকেলেঞ্জেলো” নামে পরিচিত।

পশ্চিমা শিল্পে তাঁর প্রভাব আজও অমলিন।

তিনি প্রমাণ করেছিলেন — শিল্পই মানব আত্মার মুক্তি।

মাইকেলেঞ্জেলো রেনেসাঁ মানবতার জীবন্ত প্রতীক — যিনি ঈশ্বরের সৌন্দর্যকে মানবদেহের মাধ্যমে প্রকাশ করেছিলেন।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top