পিটার পল রুবেন্স
পিটার পল রুবেন্স (Peter Paul Rubens) ছিলেন ইউরোপীয় বারোক যুগের সর্বশ্রেষ্ঠ চিত্রশিল্পীদের অন্যতম।
তিনি ২৮ জুন, ১৫৭৭ সালে জার্মানির সিগেন (Siegen) শহরে জন্মগ্রহণ করেন।
তাঁর পিতা ছিলেন জান রুবেন্স (Jan Rubens), একজন আইনজীবী।
তাঁর মাতা মারিয়া পাইপেলিঙ্কস (Maria Pypelinckx) ছিলেন গৃহিণী।
রুবেন্সের পরিবার ধর্মীয় কারণে অ্যান্টওয়ার্প থেকে নির্বাসিত হয়েছিল।
তাঁর জন্মের অল্প পরেই পরিবার কোলন (Cologne) শহরে চলে আসে।
১৫৮৭ সালে পিতার মৃত্যুর পর পরিবার অ্যান্টওয়ার্পে ফিরে আসে।
ছোটবেলায়ই রুবেন্সের আঁকার প্রতিভা স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
তিনি প্রথমে মানবিক শিক্ষা ও ক্লাসিকাল সাহিত্য অধ্যয়ন করেন।
পরে তিনি একাধিক শিল্পগুরুদের কাছে চিত্রকলার প্রশিক্ষণ নেন।
প্রথম গুরু ছিলেন Tobias Verhaecht — যিনি ল্যান্ডস্কেপ চিত্র আঁকতেন।
এরপর তিনি Adam van Noort-এর অধীনে কাজ করেন।
সর্বশেষ গুরু ছিলেন Otto van Veen (Otho Venius), যিনি রুবেন্সের শিল্পচিন্তায় গভীর প্রভাব ফেলেন।
১৬০০ সালে রুবেন্স ইতালি ভ্রমণ করেন।
ইতালিতে তিনি রেনেসাঁস শিল্পীদের কাজ গভীরভাবে অধ্যয়ন করেন।
তিনি বিশেষভাবে মাইকেলেঞ্জেলো, রাফায়েল ও টিশিয়ানের কাজ দ্বারা প্রভাবিত হন।
১৬০১ সালে তিনি ডিউক ভিনচেঞ্জো গঞ্জাগার (Duke of Mantua) রাজদরবারে কর্মরত হন।
রুবেন্স ম্যানটুয়ার প্রাসাদে চিত্রাঙ্কন ও কূটনৈতিক কাজ করতেন।
তিনি রোম, ফ্লোরেন্স ও ভেনিসে ভ্রমণ করে প্রাচীন ও সমসাময়িক শিল্পের নমুনা সংগ্রহ করেন।
১৬০৮ সালে তাঁর মায়ের অসুস্থতার খবর পেয়ে তিনি অ্যান্টওয়ার্পে ফিরে আসেন।
ফিরে এসে তিনি অ্যান্টওয়ার্পের শীর্ষস্থানীয় চিত্রশিল্পী হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন।
তিনি স্প্যানিশ রাজা ফিলিপ চতুর্থের প্রজারূপে কাজ করতেন।
১৬০৯ সালে তিনি ইসাবেলা ব্র্যান্ট (Isabella Brant)-কে বিবাহ করেন।
তাঁদের তিনটি সন্তান ছিল।
ইসাবেলার মৃত্যু রুবেন্সের জীবনে গভীর দুঃখের কারণ হয়।
১৬২৬ সালে ইসাবেলা মারা যান।
এরপর রুবেন্স ১৬৩০ সালে হেলেনা ফোর্মেন্ট (Hélène Fourment)-কে বিবাহ করেন।
হেলেনা ছিলেন তাঁর তুলনায় প্রায় ৩৭ বছর ছোট।
হেলেনাকে রুবেন্স অনেক চিত্রে আদর্শ নারীমূর্তি হিসেবে অঙ্কন করেছেন।
তাঁর শিল্পে নারীর দেহাবয়ব পূর্ণতা, প্রাণশক্তি ও বাস্তবতার প্রতীক।
তাঁর কাজের বৈশিষ্ট্য হলো শক্তিশালী গতিশীলতা, নাটকীয় আলোছায়া ও উজ্জ্বল রঙ।
তিনি তেলরঙে দক্ষ ছিলেন।
রুবেন্স প্রায়ই পৌরাণিক ও ধর্মীয় বিষয়বস্তু আঁকতেন।
তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত কাজগুলির মধ্যে রয়েছে “The Descent from the Cross”।
এই চিত্রটি অ্যান্টওয়ার্প ক্যাথেড্রালে সংরক্ষিত আছে।
আরেকটি বিখ্যাত চিত্র হলো “The Elevation of the Cross”।
তিনি রাজকীয় ও কূটনৈতিক শিল্পী হিসেবেও প্রসিদ্ধ ছিলেন।
তাঁর শিল্পে প্রাচীন গ্রীক ও রোমান পৌরাণিক কাহিনির দৃশ্য প্রায়শই দেখা যায়।
তিনি “Venus and Adonis”, “The Judgment of Paris” ইত্যাদি চিত্র এঁকেছিলেন।
তাঁর চিত্রে মানবদেহের গতিশীলতা ও পেশীর শক্তি অনন্যভাবে ফুটে ওঠে।
রুবেন্সের স্টুডিও ছিল বিশাল এবং অনেক শিক্ষার্থী তাতে কাজ করতেন।
তাঁর শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছিলেন অ্যান্টনি ভ্যান ডাইক (Anthony van Dyck)।
ভ্যান ডাইক পরবর্তীতে ইংল্যান্ডের রাজদরবারের বিখ্যাত চিত্রশিল্পী হন।
রুবেন্স তাঁর স্টুডিওকে প্রায় এক “শিল্প কারখানা”-র মতো পরিচালনা করতেন।
তিনি প্রধান অংশ আঁকতেন, আর শিক্ষার্থীরা সহায়ক অংশ সম্পন্ন করতেন।
তিনি রাজকীয় আদেশে অনেক ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক চিত্র তৈরি করেন।
রুবেন্স ফ্রান্সের রাজা ত্রয়োদশ লুই ও রাণী মারি দে মেডিচির জন্য কাজ করেন।
“Marie de’ Medici Cycle” তাঁর ফরাসি রাজপ্রাসাদের জন্য আঁকা বিখ্যাত ধারাবাহিক চিত্রমালা।
এই সিরিজে ২৪টি বিশাল চিত্র ছিল।
তিনি স্পেন ও ইংল্যান্ডের রাজদরবারের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক বজায় রাখতেন।
রুবেন্স ছিলেন একজন দক্ষ ভাষাবিদ।
তিনি লাতিন, ইতালীয়, ফরাসি, স্প্যানিশ ও ডাচ ভাষায় পারদর্শী ছিলেন।
তিনি কূটনীতিক হিসেবেও কাজ করেছেন।
১৬২৯ সালে তিনি স্পেন ও ইংল্যান্ডের মধ্যে শান্তিচুক্তি সম্পাদনে ভূমিকা রাখেন।
ইংল্যান্ডে তিনি রাজা চার্লস প্রথমের অতিথি হিসেবে ছিলেন।
চার্লস প্রথম তাঁকে নাইট উপাধি প্রদান করেন।
স্পেনের রাজা ফিলিপ চতুর্থও তাঁকে নাইট উপাধি দিয়েছিলেন।
তিনি ইউরোপের সবচেয়ে সম্মানিত শিল্পী হয়ে ওঠেন।
তাঁর কাজ সংগ্রহ করতেন অভিজাত ও রাজপরিবারের সদস্যরা।
তিনি নিজের জীবদ্দশাতেই ধনী ও প্রভাবশালী হন।
রুবেন্স ছিলেন বুদ্ধিজীবী এবং মানবতাবাদী চিন্তায় অনুপ্রাণিত।
তিনি দর্শন ও প্রাচীন ইতিহাসে আগ্রহী ছিলেন।
তাঁর বাড়িতে ছিল বিশাল গ্রন্থাগার ও শিল্পসংগ্রহ।
তিনি অ্যান্টওয়ার্পে নিজের জন্য একটি রেনেসাঁ শৈলীর প্রাসাদ নির্মাণ করেন — Rubenshuis।
Rubenshuis এখন একটি জাদুঘর।
তাঁর কাজ ইউরোপ জুড়ে বারোক শিল্পের মান নির্ধারণ করে।
তাঁর প্রভাব দেখা যায় ফরাসি, স্প্যানিশ, ও ডাচ শিল্পে।
রুবেন্সের চিত্রে রঙের ব্যবহার উজ্জ্বল, উষ্ণ ও প্রাণবন্ত।
আলো-ছায়ার নাটকীয় কনট্রাস্ট তাঁর কাজের বৈশিষ্ট্য।
তিনি প্রায়ই “রুবেনেসক নারী” (Rubenesque women) হিসেবে পরিচিত পূর্ণাঙ্গ নারীমূর্তি এঁকেছেন।
এই ধারা ইউরোপীয় সৌন্দর্যচর্চায় প্রভাব ফেলেছিল।
তিনি অনেক প্রতিকৃতি (portrait) অঙ্কন করেছেন।
রুবেন্সের স্বপ্রতিকৃতি আজও বিখ্যাত।
তাঁর স্ত্রী ও সন্তানদেরও একাধিক চিত্রে অঙ্কিত করেছেন।
তাঁর কাজের প্রধান থিম ছিল ধর্ম, পৌরাণিকতা ও মানবজীবনের মহিমা।
তিনি যুদ্ধ ও শান্তির প্রতীকী চিত্রও আঁকেন।
“The Horrors of War” তাঁর অন্যতম রাজনৈতিক প্রতীকচিত্র।
তিনি ল্যান্ডস্কেপ আঁকার ক্ষেত্রেও দক্ষ ছিলেন।
জীবনের শেষদিকে তিনি শান্তিপূর্ণ গ্রামীণ দৃশ্য আঁকতেন।
১৬৩৫ সালে তিনি একটি জমিদারি কেনেন — Het Steen নামে।
“Landscape with a Rainbow” তাঁর ঐ জমিদারির দৃশ্য থেকে আঁকা।
রুবেন্সের শরীর স্বাস্থ্যজনিত সমস্যায় ভুগতে শুরু করে।
তিনি গাউট রোগে (gout) আক্রান্ত হন।
শেষ জীবনে তিনি ধীরে ধীরে শিল্পকর্ম থেকে অবসর নেন।
৩০ মে, ১৬৪০ সালে অ্যান্টওয়ার্পে তাঁর মৃত্যু হয়।
তাঁর বয়স হয়েছিল ৬২ বছর।
তাঁকে St. James’s Church, Antwerp-এ সমাধিস্থ করা হয়।
তাঁর সমাধিক্ষেত্রে তাঁর আঁকা Virgin and Child চিত্র দেখা যায়।
রুবেন্সের মৃত্যুর পরও তাঁর শিল্পশৈলী দীর্ঘকাল ইউরোপে প্রভাব বিস্তার করে।
তাঁকে বারোক শিল্পের মূল চালিকাশক্তি বলা হয়।
তাঁর শিল্পকে “dynamic”, “theatrical”, এবং “heroic” বলা হয়।
তিনি শিল্পের মাধ্যমে শক্তি, অনুভূতি ও দেবত্ব প্রকাশ করেছেন।
আধুনিক সমালোচকরা তাঁকে “painter of life” বলে অভিহিত করেন।
তাঁর শিল্প রেনেসাঁর বুদ্ধি ও বারোকের আবেগের সংমিশ্রণ।
ইউরোপীয় মিউজিয়ামগুলোতে তাঁর শত শত কাজ সংরক্ষিত।
লুভর, প্রাডো, ন্যাশনাল গ্যালারি, হার্মিটেজে তাঁর বিখ্যাত চিত্র রয়েছে।
Rubenshuis আজও তাঁর জীবনের প্রতিচ্ছবি বহন করে।
তাঁর শিষ্যরা ইউরোপের বিভিন্ন দেশে তাঁর ধারা বহন করে।
রুবেন্সের নাম এখনো “Baroque Master” হিসেবে শ্রদ্ধার সঙ্গে উচ্চারিত হয়।
তাঁর শিল্প মানব শরীর, আবেগ ও সৌন্দর্যের এক চিরন্তন উদযাপন।









