Prokash Roy

প্রকাশ চন্দ্র রায়

বাপ দুলালী–(ছোটগল্প)

প্রকাশ চন্দ্র রায়

মা, মাগো, মা মণি-
বাপের ডাকে কাছে এসে দাঁড়ালো ময়নামতি।
-কী জন্য ডাকছ অত?
-পা দু’টো আর একটু টিপে দাও না মা, আকুতি ঝরে পড়লো বাপের কন্ঠ থেকে।
-পারবো না আর! একটু আগেই তো টিপে দিলাম। এখন স্কুলে যাচ্ছি, স্কুলে আজ বৃত্তির টাকা দিবে। তোমার জন্য ঔষধ আনতে হবে।
-ওসব ঔষধপাতি কিনে আর টাকাপয়সা নষ্ট করো না মা। তুমি আমার ঔষধ, তুমিই ডাক্তার। তুমি আমার নয়নমণি।

বলতে বলতে খক খক করে কাশতে লাগলো মধুমোহন। কাশির ধমকে কেঁপে কেঁপে উঠতে লাগলো বিছানা বালিশ। অনেকক্ষণ কাশি দেওয়ার পরে দু’হাতে বুক চেপে ধরে গোঙাতে গোঙাতে বিছানায় ঢলে পড়লো।

হাতে ধরা ছাইয়ের পাত্রটার দিকে তাকিয়ে আছে ময়নামতি। এখন যে পঁচা গয়ারগুলো ফেললো বাবা, তাতে বেশ কিছু রক্তের ছিটা। পাত্রটা মেঝেতে রেখে জড়ানো কম্বলটা ভালো করে টেনে দিল বাপের গায়ে। পায়ের কাছে বসে টিপতে লাগলো দু’টো পা।

আজ প্রায় মাসখানেক থেকে গায়ে পা’য়ে শুলুনি ব্যথা বাপের, সারাক্ষণ শুধু টিপতে হয়, এছাড়া আর অন্য কিছুতেই আরাম হয় না। তার সাথে বুকে ব্যথা, কাশ।
কেউ বলে বাত, কেউ বলে যক্ষ্মা, হাঁপানী।

কোন কিছুতেই কোন উপকার হচ্ছে না রোগের। অবশ্য সেরকম বড় ধরনের চিকিৎসা’ই করাতে পারেনি আজ পর্যন্ত। ছবি তুলে বুকটা পরীক্ষা করলে হয়তো ধরা পড়তো রোগটা কী।পয়সা অভাবে তা তো আর করাতে পারেনি তারা। এই সাধারণ কিছু ঔষধ কেনার পয়সা’ই জোটেনি ওদের। একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি তার বাবা। সে-ই তো পড়ে আছে বিছানায়।

একমাস আগে সিলেট শহরে রিক্সা চালিয়ে বেশ কিছু টাকা নিয়ে এসেছিল বাবা,তারজন্য একটা সুন্দর স্কুলব্যাগ এনেছে সিলেট থেকে। ঘাড় ঘুরিয়ে ব্যাগটার দিকে তাকালো ময়না, পিছু হটে ব্যাগটা ঘাড়ে নিল পড়ার টেবিল থেকে। বাবা’র মুখের কাছে ঝুঁকে দেখলো, ঘুমাচ্ছে, দু’চোখের কোণে নিরব কান্নার স্বাক্ষী, তপ্ত অশ্রু জমে আছে। পরনের জামার খুঁট দিয়ে মুছিয়ে দিল চোখের জল। বাপে’র বিবর্ণ কোঁচকানো কপালে চুমু খেয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো, তারপর শিয়রে রাখা টেবিলের জগ থেকে গ্লাসে জল ঢেলে একখানা বই চাপা দিয়ে আস্তে করে কপাট ভিড়িয়ে দিয়ে চললো স্কুলের পথে।

বাড়ীতে আর তো কেউ নেই! মা চম্পাবতী সাত সকালে চলে গেছে কলেজের মেস এ রান্না করতে, ফিরবে সেই বিকেল পাঁচটায়, আবার সন্ধ্যায় যাবে আর এক মেস এ রান্না করতে।
বড় ভাই মন্টুমোহন হোটেলে কাজ করে। কাজ বলতে এঁটো প্লেট গ্লাস তোলা, টেবিলে টেবিলে জলের গ্লাস এনে রাখা। এ ছাড়া আর কী করবে সে ! মাত্র তো পনের বছর বয়স তার। এরচেয়ে বড় কোন কাজ করতে দেয় না তাকে হোটেল মালিক।

সারাদিন হোটেলেই খাওয়া দাওয়া পায় মন্টুমোহন। প্রায় রাত’ই হোটেলে ঘুমায়। মাঝে মাঝে বাড়ীতে আসে বাবা, মা আর বোনকে দেখতে-যেদিন কিছু টাকা পয়সা পায় মালিকের কাছ থেকে। টাকা আর কী দৈনিক ৫০-৬০ টাকা!

মা চম্পাবতী খুব ভালবাসে ছেলে মন্টুমোহনকে। তবুও মাত্র ক্লাশ সিক্স/সেভেন পর্যন্ত পড়ায়ে আর যোগাতে পারেনি পড়াশুনার খরচ। লাগিয়ে দিয়েছে হোটেলের কাজে। মেয়ে ময়নাকেও পড়াতে চায় না মা চম্পা কিন্তু বাপের দুলালী, নয়নমণি ময়না বাপের আস্কারা’য় প্রায় মাথায় চড়ে বসেছে। ভীষন জেদী মেয়ে। সব সময় বাপের প্রশংসায় পঞ্চমুখী সে। বাবা নাকি বলেছে যে, পূর্বের জনমে সে তার মা ছিল; এ জনমে মেয়ে হয়ে জন্মেছে। এ কথায় বিশ্বাস রেখে আরও বেশী বাপঘেঁষা হয়েছে মেয়েটা। সেই ছোট্টটি থেকে এখন পর্যন্ত বাপের সাথে এক বিছায় শুয়ে এসেছে। সখ করেও একরাত মা চম্পাবতীর সাথে কাটায়নি। যত প্রকার নালিশ আবদার সব তার বাপের কাছেই। বাবা মধুমোহনও মেয়ে অন্তপ্রাণ।

ক্লাশ সিক্সের ছাত্রী ময়নামতি। বারো কি তের বছর হবে বয়স তার।
স্কুলে এসে উপবৃত্তির টাকাটা হাতে পেয়েই ভাবলো, প্রাণপ্রিয় বাপধনের জন্য কিছু ফলমূল কিনবে আর কালকেই ব্র্যাক অফিসে নিয়ে যাবে বাপকে। ওখানে নাকি গয়ার পরীক্ষা করে বিনামূল্যে চিকিৎসা প্রদান করা হয়। ভাবতে ভাবতে খুব দ্রুত হেঁটে ফলের দোকানে গিয়ে আঙুর আর আপেল কিনে বাড়ী মুখে হাঁটা ধরলো সে। হাঁটছে আর ভাবছে,ভীষন অসুস্থ বাবাকে একাই রেখে আসা উচিৎ হয়নি বোধহয়, বাবা তো একাই হাঁটাচলা করতে পারে না বেশী ; কিন্তু কী করবে আর! তারও যে খুব ইচ্ছে বৃত্তির টাকা দিয়ে বাবার জন্য কিছু কেনার আর ভালভাবে চিকিৎসা করানোর।

বাড়ীর কাছে এসে সমস্ত টাকা হাতের মুঠোয় নিলো সে, মনে মনে ভাবলো টাকাগুলো বাপের হাতেই দিবে প্রথম। হঠাৎ করে নিজ জিহবায় প্রচন্ড রকমভাবে কামড়ে দিল সে। অসহ্য যন্ত্রনার চোটে দাঁড়িয়ে পড়লো, ব্যথা সামান্য কিছু কমলে থুথু ফেললো মাটিতে, থুথুতে রক্ত!বুঝলো ভালভাবেই কেটেছে জিহবা। মনে হলো বাবা নিশ্চয়ই বারবার তার নাম করছে, সেজন্যই তার জিহবাতে কামড় পড়েছে।

অস্থিরভাবে বাড়ীতে ঢুকেই বাবা-বাবা বলে ডাকতে ডাকতে ঘরে ঢুকলো ময়না। সর্বনার্শ! বাবা কেন মাটিতে পড়ে আছে !

টেবিলে রাখা জলের জগ মাটিতে পড়ে আছে!
কাঁচের গ্লাস ভেঙ্গে খন্ড খন্ড হয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে! জলে ভেসে গেছে ঘরের মেঝে! সে জলে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে অসুস্থ মধুমোহন! মুখের কাছের জলটুকুর রং লাল। হতচকিত ময়না বাপের কাছে গিয়ে হাছড়ে পাছড়ে চিৎ করলো তার বাপকে। নাক মুখ থেকে রক্ত ঝরে লালে লাল হয়েছে মেঝের জল!

বাবার গায়ে হাত ঠেকালো ময়না,বরফঠান্ডা বাপের গা! নাকে হাত দিয়ে শ্বাস প্রশ্বাস পরীক্ষা করে-স্তব্ধ বিমূঢ় ময়না বাবা বলে বুকফাটা আর্তচিৎকার দিয়ে আছড়ে পড়লো বাবার বরফশীতল দেহের উপড়।(সমাপ্ত)

প্রকাশ চন্দ্র রায়।
থানা মোড়-কিশোরগঞ্জ।
জেলা-নীলফামারী।
মোবাইল-০১৭২৩-২৫৭৪১৫

Prokash Roy
Prokash Roy

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top