বিদায় বেলায় ব্যস্ত প্রাঙ্গণ (স্মৃতিকথা)

শামিমা সুলতানা

সময়টা ২০০৩ সাল। আমার এস এস সি পরীক্ষা শুরু হয়েছিল মার্চ মাসের মাঝামাঝি সময়ে। অনেক বেশি উৎসাহ আর ভয় দুইটাই ছিল।
পরীক্ষা শুরুর তিন মাস আগে নির্বাচনী পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর থেকেই নিজেদের মধ্যে একটা বড় বড় ভাব চলে আসছিল।
আমাদের স্কুলের নাম “জিনজিরা পীর মোহাম্মদ পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়”।
স্কুলের শ্রদ্ধেয় শিক্ষকগণ ও অত্যন্ত ভালো মনের অধিকারী ছিলেন। আমাদের শ্রদ্ধেয় ম্যাডাম দের ব্যবহার ছিল অমায়িক। আর শ্রদ্ধেয় স্যারগণ ছিলেন বন্ধুর মতোন।
তৃতীয় শ্রেণী হতে এস এস সি পরীক্ষা দীর্ঘ আট বছর স্কুল জীবনের আনন্দময় সময়ের অবসান ঘটতে চলছিলো।
আমাদের চোখে ছিল নতুন স্বপ্ন। একদিকে ছিল পরীক্ষার পরে কলেজে যাওয়ার স্বপ্ন আর অন্যদিকে ছিল প্রাণপ্রিয় প্রাঙ্গণ ছেড়ে যাওয়ার কষ্ট।
নির্বাচনী পরীক্ষার পর আর লম্বা সময়ের ক্লাস হয় নি। শুধু দুই ঘণ্টার কোচিং ক্লাস হতো। একদিন ও কোচিং ক্লাস মিস করিনি। সে বছর স্কুলের সকল অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকেছি। কত আনন্দের সময় ছিল তখন। খুব মনে পড়ে।
দেখতে দেখতে বিদায় অনুষ্ঠান এসে গেল।
আমরা সবাই সেদিন শাড়ি পড়েছিলাম। আমাদের স্কুল মাঠ খুব সুন্দর করে সাজানো হয়েছিল। অনুষ্ঠানে শ্রদ্ধেয় প্রধান শিক্ষক ও সম্মানিত অতিথিরা বক্তব্য রেখেছিলেন। দশম শ্রেণীর শিক্ষার্থীরা মানপত্র পাঠ করেছিল। স্কুল থেকে বিদায়ী শিক্ষার্থী হিসেবে আমাদের সকল কে উপহার দেয়া হয়েছে। শৈশবকালে আসা সেই প্রাঙ্গণে ছিল আমাদের অনেক স্মৃতি। ছিল শৈশব থেকে শুরু করে কৈশোর কালের সকল বন্ধু। সব ছেড়ে মনে কষ্ট আর চোখে স্বপ্ন নিয়ে স্কুল ছেড়ে এসেছিলাম।
পরীক্ষা শুরুর দিন। ভোর ৪:০০ টায় ঘুম থেকে উঠে দেখি বাইরে কালবৈশাখীর ঝড় হচ্ছে। প্রথম পরীক্ষার দিন এমন ঝড় শুরু হওয়ায় মনটা অনেক খারাপ হয়ে গেল। কিন্তু সকাল হতে হতে ঝড় থেমে আকাশ পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল। আমি আবার ৭:০০ টা পর্যন্ত পড়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। প্রায় ৮:৩০ মিনিটে আমার ফুফু আমাকে জাগিয়ে তুলে নাস্তা করান। যে স্কুলে আমাদের সিট পড়েছে সেই স্কুল আমার বাসা থেকে ৫ মিনিট দূরত্বে অবস্থিত। ঠিক ৯:০৫ মিনিটে তৈরি হয়ে বের হই কেন্দ্রে যাওয়ার জন্য। আর আমার সাথে- ফুফু, আব্বু, আম্মু, নানি, ফুফা, ফুফাতো ভাই, এলাকার বড় ভাই, আমার শ্রদ্ধেয় প্রাইভেট টিচার সবাই গেলেন কেন্দ্রে। এখনকার ছেলেমেয়েরা শুনলে হাসবে কিন্তু বরাবরই এস এস সি পরীক্ষা কে অনেক গুরুত্ব দেয়া হয়, আর তাই পরিবারের সবাই অন্তত একবার হলেও পরীক্ষার্থী কে দেখতে আসতো। পরীক্ষার্থীর জন্য দোয়া করত সবাই। নানান ধরনের নাস্তা ও খাবার পাঠিয়ে দিত আত্মীয়-স্বজনেরা।
দেখতে দেখতে পরীক্ষা শেষ। প্রাকটিক্যাল পরীক্ষা চলা পর্যন্ত ও এতটা কষ্ট লাগে নি।
কিন্তু যখন পরীক্ষা সম্পূর্ণ শেষ আর স্কুলে যাওয়া হয় না তখন থেকেই খারাপ লাগা শুরু হলো। আমাদের সময় তো মোবাইল তেমন একটা ছিল না তাই আর কারো সাথে যোগাযোগ করা সম্ভব হয় নি।
দিন কেটে যাচ্ছিল ফলাফলের আশায়। অপেক্ষার প্রহর ভেঙ্গে ফলাফলের দিন আসলো।
আমার জীবনের সবচেয়ে আনন্দময় দিন ছিল সেদিন। ২০০১ সাল থেকে শুরু হয় গ্ৰেডিং পদ্ধতি। তাই তখন আমাদের গার্ডিয়ানরা এ+ নিয়ে এত মাথাব্যথা করত না। ঠিক বিকেল ৪:০০ টায় স্কুল প্রাঙ্গণের নোটিশ বোর্ডে ফলাফল টানানো হবে। নির্ধারিত সময়ের আগেই আমরা স্কুলে উপস্থিত হই।
ভয়ে গলা শুকিয়ে কাঠ। হাত,পা যথারীতি কাঁপা শুরু করল।
ফলাফল টানানো হলো। সবাই যার যার নিজের রোল নম্বর খুঁজতে ব্যস্ত। কারো মুখে হাসি তো কারো চোখে অশ্রু।
এই অশ্রু ছিল কারোটা আনন্দের আবার কারো টা বেদনার। অনেক কষ্টে কাঁপা কাঁপি বাদ দিয়ে নোটিশ বোর্ডে নিজের রোল নম্বর টা খুঁজতে গেলাম। আলহামদুলিল্লাহ পেয়েছি, পাশ ৩.৩১ পয়েন্ট। আর তাতেই আমার পরিবার আনন্দে আত্মহারা। কিন্তু আনন্দ টা বেশিক্ষণ সময় স্থায়ী হয় নি। কারণ আমার অনেক ক্লাসমেট আর বন্ধুরা পরীক্ষায় পাশ করতে পারেনি। আর তাদের জন্য অনেক মন খারাপ ছিল।
আমাদের বাসায় ছিল সেদিন উৎসবমুখর পরিবেশ। সকল আত্মীয়-স্বজনেরা আমার জন্য গিফট হাতে নিয়ে আসছিল। আমার এক ভাগ্নে আমার জন্য একটা বড়সড় ফুলের তোরা নিয়ে আসছিল। রাতে বাসায় অনেক রান্না-বান্না হয়েছে। আমার আব্বু মধ্যেবিত্ত পরিবারের হলেও মনটা ছিল বিশাল বড়। প্রায় দুই মণ মিষ্টি বিতরণ করেছেন আমার আব্বু।
তোমরা যারা এখন এস এস সি পরীক্ষা দিবে হয়তো ভাববে এই রেজাল্ট নিয়ে কত আনন্দ করেছি।
আসলে পরীক্ষা অথবা ফলাফল কোনোদিন ভাগ্য নির্ধারণ করে না। সবসময় চেষ্টা চালিয়ে যেতে হয় ভাগ্য নির্ধারণ করবেন উপরওয়ালা। আর সবার মেধা কখনো একরকম হয় না। যার যার মেধা ও যোগ্যতা অনুযায়ী প্রাপ্যটুকু অবশ্যই দিবেন তিনি। সেটা নিয়ে সন্তুষ্ট হয়েই আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। আমার নিজের এস এস সি পরীক্ষার স্মৃতিচারণ করলাম আপনাদের সাথে আশা করি আপনাদের ভালো লাগবে আর হ্যাঁ, ভবিষ্যতে সকল এস এস সি পরীক্ষার্থীদের জন্য রইলো শুভকামনা।

ই-মেইল: p91114162@gmail.com

2 thoughts on “বিদায় বেলায় ব্যস্ত প্রাঙ্গণ (স্মৃতিকথা)”

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top