পরিনীতা

বাবার বদলির চাকরির জন্য সহেলিদের অনেক জায়গায় ঘুরতে হয় |তিন/ চার বছর পর পর বাবার বদলির জন্য আজ ওরা এসেছে এক নতুন শহরে বছরের মাঝে | নতুন স্কুল ,নতুন বন্ধু হবে ভেবেই সহেলীর খুব আনন্দ , তবে পুরোনো বন্ধুদের কথা মনে পড়বে , এখনও ওদের অভাবও বোধ হচ্ছে,মনও খারাপ হচ্ছে | এই দেখে সহেলীর বাবা বলল, তুই আমার এতো মিশুকে , মিষ্টি একটা মেয়ে যার নাকি মুখে সারাক্ষন খই ফুটছে | সে ভয় পাচ্ছে ?এখানেও দেখবি তোর আবার অনেক নতুন বন্ধু হয়ে যাবে | কাল তোকে তোর নতুন স্কুলে নিয়ে যাবো |স্কুলটি খুব সুন্দর|চারদিক গাছপালা , ফুল ফল দিয়ে ঘেরা | বিশাল খেলার মাঠ ,বড় লাইব্রেরী আছে | আমার বিশ্বাস দিদিমনিদের তুই তোর ব্যবহার , লেখাপড়া গানবাজনা দিয়ে মন জয় করে নিতে পারবি |এতো ভয় পাবার কি আছে? সব ঠিক হয়ে যাবে |
কিন্তু বাবা , বছরের মাঝে আবার নতুন বই নতুন সিলেবাস নিয়ে কি আমি ভালো রেজাল্ট করতে পারবো ? _ সহেলী বলল|
সহেলীর বাবা বলে উঠলেন ,কেন পারবি না ? তাছাড়া আমি আছি তো , আমি তোকে সাহায্য করবো |
পরদিন সহেলী নতুন স্কুলে গিয়ে সেখানকার পরিবেশ ও পড়াশোনা দেখে খুব খুশি হয়ে উঠল |
ধীরে ধীরে নতুন বন্ধু হল | লেখাপড়ায় সে চিরকালই খুব ভালো | স্কুলের নানান ফাংশানে গান গেয়ে দিদিমনি ,বন্ধুদের চোখের মনি হয়ে উঠলো | স্কুলের ফাইনাল পরীক্ষায় প্রথম হয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিল | চঞ্চল ,মিশুক স্বভাবের মেয়েটি স্কুল , পাড়া প্রতিবেশি সবার খুব পছন্দের ও আদরের হয়ে উঠলো | এছাড়া সেই শহরে সহেলীর নানা ফাংশানে গান সবাইকে মুগ্ধ করতো | ভালো গায়িকা হিসাবে বছর দুয়েকের মধ্যে পনের বছরের কিশোরীর বেশ নাম ডাক হল |
যেখানে ওরা থাকত , সেখানে পাশের বাড়ি জেঠিমা আর ওর মা অল্প সময়ের মধ্যে খুব ভালো সখ্যতা গড়ে উঠলো | দত্ত জেঠু ও জেঠিমা নিজের মেয়ে না থাকায় ওকে পেয়ে নিজের মেয়ের মতো ভালোবাসতে শুরু করলেন | কিন্তু ,ওনাদের একমাত্র সন্তান সহেলীর চেয়ে বছর চারেক বড় বিশালের সাথে প্রথমে তেমন ভাবে বন্ধুত্ব গড়ে উঠল না | বিশাল মায়ের সহেলীর প্রতি অধিক প্রশয় আর ভালোবাসা কেন জানি সহ্য হত না|
সহেলীকে দেখলেই বলত , এই তোর মায়ের কাছে যা |আদর খাবার জন্য আমার মাকে কেন দরকার ?
সহেলী উত্তর দিত ,যাবো না , কি করবে তুমি ?
বিশাল রেগে গিয়ে সহেলীর চুলের মুঠি ধরে টান দিত|সহেলী ‘জেঠিমা গো’ বলে চিৎকার করে উঠতো |
দত্ত গিন্নি,দৌড়ে এসে দুজনকে ছাড়াতো |ছেলেকে বকা দিয়ে সহেলীকে জড়িয়ে ধরে ঘরে নিয়ে যেতেন |সহেলী পিছন ঘুরে বিশালকে জিহ্ব ভেঙ্গিয়ে দিত |
বিশালের লেখাপড়ায় ,খেলাধুলায় সেই শহরে বেশ নাম আছে | ধীরে ধীরে দুজনের শত্রুতা কখন যেন বন্ধুত্ব থেকে ভালো লাগায় পরিনত হলো ,সেটা ওরা নিজেরাই বুঝতে পারলো না | কিন্তু বুৃঝতে ও আন্দাজ করতে পারলো ওদের অভিভাবকরা |
এত ছোট বয়সে প্রেম ওনারা কেউ মানতে চাইলেন না |
দুজনের মেলামেশা দেখাশোনা বন্ধ করে দেওয়া হল | সহেলীকে তার বাবা কোনদিন গায়ে হাত তোলেন নি ,তিনি তার আদরের মেয়ের গায়ে হাত তুললেন |ঘরে বন্ধ করে রাখলেন | আশ্চর্য ! সহেলী তার বাবার কাছে একবার দুবার কাতর বিনতী ,কান্না কাটি করলেও বাবার জেদের কাছে হার মেনে নিয়ে একদম চুপ হয়ে গেল |চঞ্চল মেয়েটা হঠাৎ করে একদম শান্ত হয়ে গেল | কারো সাথে কথা বলাই বন্ধ করে দিল |
এদিকে সহেলীর বাবার অন্য শহরের বদলি অর্ডার এসে গেল | সহেলীরও মাধ্যমিক পরীক্ষা এসে গেল |মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ হতেই জোর করে মেয়েকে অন্য শহরে নিয়ে চলে গেলেন | ভাবলেন , দুজনকে আলাদা করে দিলেই বোধহয় সব কিছুর সমাধান হয়ে যাবে | কিন্তু , তা কখনই হল না | সহেলীর শেষ পরীক্ষার দিন দুজনে দেখা করে শপথ নিল ,ওরা নিজের পায়ে দাঁড়াবে এবং নিজেদেরকে সবার কাছে যোগ্য প্রমান করেই দেখাবে |তবেই আবার ওরা দেখা করবে |ততদিন মাসে একবার ফোন করে কথা বলবে দুজনে| নিজেদের ভালোবাসাকে এভাবে শেষ হতে দেবে না | চোখের জলে দুজন দুজনকে বিদায় জানালো |
এরপর হাসিখুশি মেয়েটি কেমন চুপ হয়ে গেল|কেউ কথা বললে উত্তর দেয় ,নাহলে চুপ করেই থাকতো |শুধু গান করতে বসলে ওর গলা শোনা যেত |
সহেলী মাধ্যমিক ,উচ্চমাধ্যমিকে দূর্দান্ত রেজাল্ট করে ইংলিশে অর্নাস নিয়ে ভর্তি হল |
সেই শহর থেকে ফিরে আসার পর পাঁচটা বছর কেটে গিয়েছে | সহেলী আর বিশাল তাদের সিদ্ধান্ত মতো ফোনে কথা বলতো | সহেলীর বাবা ,মা নিজেদের এতো হাসি খুশি মেয়েটির এইরকম পরিস্থিতি দেখে মনে মনে খুব কষ্ট পেতেন |
মেয়ের কাছে বিয়ের কথা একদিন তুলে বললেন , মামনি ,তোর বিয়ের ব্যবস্থা করি ?
সহেলী কিছুক্ষন চুপ থেকে বলল , চেষ্টা করে দেখতে পারো |তবে তার আগে এক বাটি বিষ দিও ,খেয়ে আমি আমার প্রান জুড়োবো |
এই কথা শুনে সহেলীর মা বাবা চমকে উঠলেন | নিজেদের ভুলটার জন্য ছেলেমেয়ে দুটোকে খুব কষ্ট দিয়ে ফেলেছেন |
এরপর তারা খুবই গোপনে বিশালের মা বাবার যোগাযোগ করে দুজনের বিয়ের ব্যবস্থা শুরু করলেন |
এদিকে বিশাল একজন নামী ডাক্তার হয়ে উঠেছে |সহেলীও একজন নামকরা গায়িকা হয়ে উঠেছে |
সহেলীর অর্নাস পরীক্ষার শেষ দিন কলেজ থেকে বের হতেই কলেজের গেটের সামনে বিশালকে দেখতে পেল |দুজন দুজনকে দেখে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো |
বিশাল সহেলীর রুপে মুগ্ধ হয়ে ভাবতে লাগলো ,আমার চুটকি পাগলী কি সুন্দর দেখতে হয়েছে!
সহেলী কাছে আসতেই দুজনের অভিভাবক ওদের ঘিরে ধরলো | সকলে বলে উঠলেন , এবার তোদের হাতকড়ি পরার সময় হয়েছে | চলো ,বাড়ি চলো দুজনে |
এরপর ,এক অগ্রহায়নে চার হাত এক হল| সহেলী বিশালের পরিনীতা হয়ে চিরসুখী হয়ে উঠলো| ওদের প্রেম সার্থক হলো ।
শাঁওলী সরকার

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top