সলিল চৌধুরী স্মরণে

শ্রী কুমার ভট্টাচার্য

সলিল চৌধুরীর জীবনের দিকে তাকালেই মনে হয় এক বিপন্ন কিন্তু অকুতোভয় ঝড়ের খেয়ার যাত্রীর কথা, এক হাতে যিনি ধরে আছেন ঝড়ের ঝুঁটি আর এক হাতে বৈঠা,আর রচনা করে চলেছেন ঝড়ের উদাত্ত সঙ্গীত।ঝড় তাঁকে বিপর্যস্ত করেছে কিন্তু বিধ্বস্ত করতে পারেনি।এই অপরাজিত প্রাণশক্তিতেই সলিল অসাধারণ। আর লক্ষ্য করা যেতে পারে জীবনের শেষ প্রান্ত পর্যন্ত এই অটুট মনোবল তাঁকে অনেক উত্তরঙ্গ নদী অবলীলায় পার করে দিয়েছে।
জীবনযাপনে সবার ক্ষেত্রে সবকিছু একি ছাঁদে মিলে যায় না।তাই কোনো কোনো জীবন বিপরীত স্রোতে ভেসে চলার অভ্যাস আর সাহস খুঁজে নেয়।
শ্রদ্ধেয় অমিয় ভট্টাচার্য সলিল চৌধুরীর মূল্যায়ন প্রসঙ্গে লিখেছেন “১৯৪৪-৪৫ সালের বাংলাদেশের কথা মনে পড়ে। বিশ্বযুদ্ধ, মহামন্বন্তর, ইংরাজ শাসকের অসহনীয় অত্যাচার আর পরাধীনতার বাঁধন ছেঁড়ার মরণজয়ী সংগ্রাম —এই নিরাপত্তা হীন অনিশ্চিত পটভূমিকায় সলিল তাঁর তারুন্যের জ্বালা নিয়ে চোখ মেলে তাকিয়েছিলেন রুদ্র জীবন পরিবেশের দিকে।”বস্তুতঃ এই দুঃসহ জীবন ই তাঁকে তাকে আর্ত ,পীড়িত,অত্যাচারিত স্বাধিকার অর্জনে বঞ্চিত পরাধীন দেশের সংগ্রামী জীবনবোধের সঙ্গে যুক্ত হতে আহ্বান জানিয়েছিল।তাই সলিল চৌধুরী আর সহজ সরল ব্যক্তিকেন্দ্রিক বৃত্তে সামিল হতে চাননি। সলিল চৌধুরীর শৈশব থেকে কৈশোর পর্যন্ত বিস্তৃত কালপরিধিটুকুর মধ্যেই তো নিয়ত পরিবর্তনশীল অবস্থান কে লক্ষ্য করা যায়।
সলিলের জন্ম দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার গাজিপুর গ্রামে। কিছু দিন পরই বাবার সঙ্গে চলে যান আসামে।আবার ৬ বছর বয়সে ফিরে আসেন কলকাতায় পড়ালেখার জন্য।থাকতেন সুকিয়া স্ট্রীটে জ্যাঠামশাই এর বাড়ি তে।আর এখানেই জেঠতুতো দাদা নিখিল চৌধুরীর কাছে পিয়ানো, বেহালা, এসরাজ ইত্যাদি বাজনা শিখে নেন। আরও কিছুদিন পর দক্ষিণ ২৪পরগণার কোদালিয়ায় মামার বাড়ি তে চলে যান এবং ভর্তি হন হরিনাভী স্কূলে। এখানে এসেই সলিলের জীবনে কমিউনিস্ট পার্টির সংস্পর্শে ধীরে ধীরে সামাজিক ও রাজনৈতিক চেতনা গড়ে উঠল। অর্থাৎ সলিল চৌধুরীর মানসিকতায় আজীবন যে এক বিপ্লবী রাজনৈতিক চেতনার প্রভাব লক্ষ করা যায়,তার ভিত্তি এখানে। বিপ্লবী আদর্শের প্রতি ছিল তাঁর অকৃত্রিম নিষ্ঠা।তাই চল্লিশের দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে প্রায় শেষ পর্যন্ত কমিউনিস্ট পার্টির কোনো না কোনো সংগঠকের
ভূমিকা তিনি গ্রহণ করেছিলেন। কখনো কৃষক সংগ্রামের সাথী হয়েছেন, কখনো ছাত্র ফেডারেশনের সংগঠন করেছেন, কখনো গণনাট্যের জন্য গান লিখেছেন,সুর দিয়েছেন, স্কোয়াড তৈরি করেছেন, আবার নাটক ও লিখেছেন। তাঁর অজস্র গণসঙ্গীত রচনার উৎস এখানেই।গানগুলি শুনলেই মনে হয় এই গান গুলি মূলত আন্দোলন কে সংগঠিত করার জন্য ই রচিত। অথচ সুরের বৈচিত্রে তা জনমানস কে অনুপ্রানিত করে তুলত।
ঠিক এই সময়ই সলিল ২৪পরগণার কৃষক নেতা হরিধন চক্রবর্তীর সঙ্গে সুদূর কৃষক অঞ্চলে ঘুরে বেড়াতেন আন্দোলনের প্রয়োজনে। আর এই প্রত্যক্ষ সংগ্রামের অভিজ্ঞতা থেকে জন্ম নিয়েছে তাঁর সঙ্গীত সৃষ্টির অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফসলগুলি। সলিল নিজেই এই সময়ের কথা লিখে গিয়েছেন —-আমি যে সময় “হই সামালো ধান হো কাস্তে টা দাও সান হো( তে ভাগা আন্দোলনের গান), আমার প্রতিবাদের ভাষা, আমার প্রতিরোধের আগুন ‘(গনতান্ত্রিক আন্দোলন কে বেআইনি করার বিরুদ্ধে) প্রভৃতি গান সৃষ্টি করেছিলুম তখন আমি বামপন্থী কৃষক আন্দোলনের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত।
সলিল বোম্বাই চলে যান ১৯৫২সালে। তার আগেই অবশ্য চলচ্চিত্র জগতে তাঁর প্রবেশ ঘটেছে। তখন থেকেই তিনি সংগঠন থেকে বিচ্ছিন্ন তবু বিস্ময় কর ভাবে তিনি তাঁর পরবর্তী জীবনেও বেশ কিছু গান লিখেছেন যেগুলি নিশ্চিত ভাবে তাঁর পূর্ববর্তী জীবনবোধে সঞ্জীবিত।
সলিল চৌধুরীর শিল্পী ব্যক্তিত্বকে একটু বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় তাঁর মূল সুর দুটি –একটি গানে অপরটি কবিতায় গুঞ্জিত। কখনও একটি অপূর্ব লিরিক ধর্মী কবিতাই সামান্য রূপ বদল করে পরিণত হিয়েছে গানে আবার সঙ্গীতের প্রভাবে অনেক চমৎকার কবিতার জন্ম হয়েছে ।
সলিল চৌধুরী নাটক ও লিখেছেন গল্পও লিখেছেন।যেমন বিখ্যাত “দো বিঘা জমিন”চলচ্চিত্র টির কাহিনী ও চিত্রনাট্য তিনি ই লিখেছেন। তবে শিল্পে তাঁর প্রধান বিচরণ ক্ষেত্র কবিতা এবং গান। বোম্বাই চলে যাওয়ার পর তিনি যে সব গান লিখেছেন তার বেশিরভাগই ব্যক্তিগত অনুভূতি বিধৃত সুখস্মৃতি, বিচ্ছেদ বেদনা, প্রেমের সুধা বিষ ঢালা। আধুনিক বাংলা গানে এমন অনবদ্য লিরিক বিচিত্র সুরের মিশ্রণে সমকালে আর কেউ লিখেছেন বলে জানি না।
সলিল চৌধুরী তাঁর জীবনের শেষ দিকে একটি গান(বা কবিতা )রচনা করেছিলেন তা থেকে কিছু অংশ উদ্ধৃত করে এই নিবন্ধ শেষ করছি।
এই রোকো রোকো
পৃথিবীর গাড়িটা থামাও।
আমি নেমে যাবো।
আমার টিকিট কাটা
অনেক দূরের
এ গাড়ি যাবে না
আমি অন্য গাড়ি নেবো।
আমার স্বপ্নভরা লাগেজ নামাও
এই কুলি মহাকাল, কাঁধে তুলে নাও।
সলিল আমাদের জন্য যা রেখে গিয়েছেন তাকে নিয়ে আমরা দীর্ঘকাল ধরে দূরপথ পরিক্রমা করবো। কিন্তু যে স্বপ্নভরা ঝুলিটা সঙ্গে নিয়ে তিনি মহাজীবনের পথে যাত্রা করলেন —সেই অপরূপ স্বপ্নগুলি আমাদের দীর্ঘশ্বাসে কোথায় যেন মিলিয়ে গেল।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top