বিধান চন্দ্র সান্যাল
” ওগো শীত, ওগো শুভ্র, হে তীব্র নির্মম,
তোমার উত্তরবায়ু দুরন্ত দুর্দম।
অরণ্যের বক্ষ হানে । “
ভূমিকা :- শীতের সকাল এক মোহময়ী রূপের প্রতিচ্ছবি, যেখানে ঘন কুয়াশার চাদর ভেদ করে নরম রোদ উঁকি দেয়, ঘাসের ডগায় জমে থাকা শিশির মুক্তোর মতো ঝলমল করে, আর খেজুর রস ও পিঠাপুলির মিষ্টি গন্ধে গ্রামবাংলা ভরে ওঠে, যা এক শান্ত ও স্নিগ্ধ পরিবেশ সৃষ্টি করে, যেখানে মানুষজন উষ্ণতার খোঁজে লেপ মুড়ি দিয়ে গল্প করে বা আগুনের পাশে বসে শীতের অলসতা উপভোগ করে।
কুয়াশার আবরণ: ভোরের আলো ফোটার আগেই চারদিক ঘন কুয়াশায় ঢেকে যায়, যা চারপাশের সবকিছুকে এক রহস্যময় আবরণে মুড়ে রাখে। এই কুয়াশা ভেদ করে সূর্যের প্রথম রশ্মি যখন মাটিতে পড়ে, তখন এক মায়াবী পরিবেশের সৃষ্টি হয়। কবি মন বলে ওঠে —
” শীতের সকাল, ঘন কুয়াশার চাদর,
ফ্যাকাশে আলোয় ঢেকেছে চরাচর।
শিশিরের শব্দে ভিজে মাটির সোঁদা ঘ্রাণ,
আলতো পায়ে আসে যেন রূপকথার প্রান।
গাছেদের ডালে জমেছে মুক্তোর কণা,
নীলিমার ক্যানভাসে কুয়াশার আনাগোনা।
পথঘাট সব ঢেকেছে ধূসর মায়ায়,
স্মৃতির ভেলায় ভাসে শৈশবের সেই সময়।”
শিশির বিন্দুর ঝলক: ঘাস, পাতা ও ফুলের ওপর জমে থাকা শিশির বিন্দুগুলো ভোরের আলোয় মুক্তোর মতো চিকচিক করে, যা দেখতে অসাধারণ লাগে। কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সে সৌন্দর্যে মোহিত হয়ে লিখেছিলেন —-
“বহু দিন ধ’রে বহু ক্রোশ দূরে
বহু ব্যয় করি বহু দেশ ঘুরে
দেখিতে গিয়েছি পর্বতমালা,
দেখিতে গিয়েছি সিন্ধু।
দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া
ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া
একটি ধানের শিষের উপরে
একটি শিশিরবিন্দু।”
গ্রামীণ চিত্র: গ্রামবাংলার শীতের সকাল এক অন্যরকম আকর্ষণ। মা-চাচিরা উনুনে খেজুর রস জ্বাল দিয়ে পিঠা তৈরি করেন, তাদের গল্প আর হাসি-আনন্দে সকালটা মুখরিত হয়ে ওঠে। কৃষকরা তাদের গবাদি পশু নিয়ে মাঠে বের হন, আর শিশুরা লেপ মুড়ি দিয়ে গল্প করে বা উষ্ণতার খোঁজে ছোটাছুটি করে।
নরম রোদ: শীতের সকালের মিষ্টি রোদ সারাদিনের জড়তা কাটিয়ে এক নতুন উদ্যম নিয়ে আসে। এই রোদে বসে গরম চায়ের কাপে চুমুক দেওয়া বা কম্বলের নিচে শুয়ে বই পড়া—এই আরামটুকু শীতের সকালকেই উপভোগ্য করে তোলে। বস্ত্রহীন অনেকের কাছেই তো সূর্যের উত্তাপই শীতের চাদর। সমস্ত রাত আমরা প্রতীক্ষা করে থাকি সূর্যদেবের জন্য। কবি সুকান্তের কন্ঠে তাই ধ্বনিত হয় —–
” হে সূর্য! শীতের সূর্য!
হীম শীতল সুদীর্ঘ্ রাত তোমার প্রতীক্ষায়
আমরা থাকি,
যেমন প্রতীক্ষা করে থাকে কৃষকদের চঞ্চল চোখ
ধান কাটার রোমাঞ্চকর দিনগুলির জন্য । “
ঋতুর রাজা: শীতের এই শান্ত, স্নিগ্ধ ও উৎসবমুখর সকাল প্রকৃতিকে এক রাজকীয় মর্যাদা দেয়, তাই অনেক কবি ও সাহিত্যিক শীতকে ঋতুর রাজা হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। মন গেয়ে ওঠে – ” জাগুক মন কাঁপুক বন, উড়ুক্কু ঝরা পাতা , / উঠুক জয়, তোমার জয় , তোমারই জয় গাঁথা
উপসংহার :- শীতের সকাল শুধু একটি ঋতুর অংশ নয়, এটি আমাদের জীবনে এক ধরনের প্রশান্তি ও নস্টালজিয়া নিয়ে আসে, যা সারাদিন আমাদের মনে এক অন্যরকম আমেজ ধরে রাখে। ঋতুরঙ্গশালায় শুরু হবে আবার পর্যায়ক্রমিক যাওয়া আসা । আমাদের অপেক্ষা করে থাকতে হবে আরো একটি বছরের জন্য। আবার শীত দেখা দেবে একতারা বাজিয়ে, কখনো জেগে উঠবে তার বৈরাগ্যের সুর । নতুন করে আমরা হবো প্রাণ চঞ্চল। জীবনের স্পন্দন জাগিয়ে তুলবে । আনন্দের স্পর্শ ছড়িয়ে দেবে মনে মনে ।
Bidhan Chandra Sanyal




















