Diego Rivera-Mexico

🎨 ডিয়েগো রিভেরার জীবন ও শিল্পযাত্রা

ডিয়েগো মারিয়া দে লা কনসেপসিওন হুয়ান নেপোমুসেনো এস্টানিসলাও দে রিভেরা ই বারিয়েন্তোস (Diego María de la Concepción Juan Nepomuceno Estanislao de Rivera y Barrientos) ছিলেন পূর্ণ নাম।

তিনি ১৮৮৬ সালের ৮ ডিসেম্বর মেক্সিকোর গুয়ানাহুয়াতো শহরে জন্মগ্রহণ করেন।

তাঁর পিতা ছিলেন এক শিক্ষক এবং সংস্কৃতিমনা মানুষ।

অল্প বয়স থেকেই ডিয়েগো চিত্রাঙ্কনে অসাধারণ প্রতিভা প্রদর্শন করেন।

চার বছর বয়সে তিনি দেয়ালে আঁকা শুরু করেন, যা পরবর্তীতে তাঁর শিল্পজীবনের প্রতীক হয়ে ওঠে।

তিনি মেক্সিকোর বিখ্যাত “Academy of San Carlos”-এ চিত্রকলার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেন।

তাঁর প্রতিভা দেখে সরকার তাঁকে ইউরোপে উচ্চশিক্ষার জন্য বৃত্তি দেয়।

১৯০৭ সালে তিনি ইউরোপে যান, প্রথমে স্পেনে, পরে প্যারিসে।

প্যারিসে তিনি পিকাসো, ব্রাক প্রমুখ কিউবিস্ট শিল্পীদের সঙ্গে মেলামেশা করেন।

তাঁর প্রাথমিক ইউরোপীয় কাজগুলিতে কিউবিজমের গভীর প্রভাব দেখা যায়।

রিভেরা স্পেন ও ফ্রান্সে বিভিন্ন প্রদর্শনীতে অংশ নেন।

তাঁর প্রথম দিকের কাজগুলোতে জ্যামিতিক আকার ও রঙের সাহসী ব্যবহার লক্ষণীয়।

১৯১৫ সালের দিকে তিনি কিউবিস্ট আন্দোলনের অংশ ছিলেন।

পরবর্তীতে তিনি কিউবিজম থেকে সরে এসে সামাজিক বাস্তবতার দিকে ঝুঁকেন।

১৯২১ সালে তিনি মেক্সিকোতে ফিরে আসেন।

দেশে ফিরে তিনি “মেক্সিকান মুরাল মুভমেন্ট”-এর অন্যতম নেতা হয়ে ওঠেন।

এই আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল জনসাধারণের জন্য দেয়ালে চিত্রকলার মাধ্যমে জাতির ইতিহাস ও সংস্কৃতি তুলে ধরা।

রিভেরা বিশ্বাস করতেন, শিল্প সবার জন্য — শুধু ধনী শ্রেণির জন্য নয়।

তিনি চান তাঁর শিল্প যেন অশিক্ষিত মানুষও বুঝতে পারে।

তাঁর দেয়ালচিত্রে শ্রমিক, কৃষক ও সাধারণ মানুষের জীবনচিত্র উঠে আসে।

তাঁর অন্যতম বিখ্যাত মুরাল সিরিজ তৈরি হয় মেক্সিকো সিটির শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ভবনে।

এই মুরালগুলো মেক্সিকোর শ্রমিক ও কৃষক সমাজের সংগ্রামের প্রতীক হয়ে ওঠে।

রিভেরার কাজ রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে অত্যন্ত শক্তিশালী ছিল।

তিনি মার্কসবাদে বিশ্বাসী ছিলেন।

তাঁর শিল্পে সামাজিক সমতা ও বিপ্লবের ভাবনা ফুটে উঠত।

১৯২৯ সালে তিনি বিখ্যাত শিল্পী ফ্রিদা কাহলো-কে বিয়ে করেন।

ফ্রিদা তাঁর চেয়ে ২০ বছরের ছোট ছিলেন।

তাদের দাম্পত্য জীবন ছিল অত্যন্ত উথালপাতাল, কিন্তু শিল্পীজীবনে একে অপরের গভীর প্রভাব রেখেছেন।

রিভেরা ফ্রিদার প্রতিভাকে স্বীকৃতি দিতে প্রথম থেকেই উৎসাহ দেন।

তাঁরা দুজনেই একে অপরের প্রতিকৃতি এঁকেছেন।

রিভেরা যুক্তরাষ্ট্রে একাধিক বড় প্রজেক্টে কাজ করেছেন।

১৯৩২ সালে তিনি ডেট্রয়েটে “Detroit Industry Murals” তৈরি করেন।

এই মুরালকে আজ ডেট্রয়েট ইন্সটিটিউট অফ আর্টস-এর প্রধান আকর্ষণ বলা হয়।

এতে আমেরিকান শিল্পায়ন ও শ্রমজীবী মানুষের অবদান তুলে ধরা হয়েছে।

রিভেরার কাজ যুক্তরাষ্ট্রে প্রশংসিত হলেও বিতর্কও সৃষ্টি করে।

১৯৩৩ সালে নিউইয়র্কে রকফেলার সেন্টারে তাঁর একটি মুরাল কমিশন করা হয়।

তিনি সেই মুরালে লেনিন-এর ছবি আঁকেন।

এতে রকফেলার পরিবার ক্ষুব্ধ হয়ে মুরালটি ধ্বংস করে দেয়।

এই ঘটনা শিল্প ও রাজনীতির সংঘর্ষের প্রতীক হয়ে ওঠে।

পরে রিভেরা একই চিত্র পুনরায় মেক্সিকোতে আঁকেন, নাম দেন “Man, Controller of the Universe।”

তাঁর শিল্পের মূল বিষয় ছিল—মানবতা, শ্রম, বিজ্ঞান, ইতিহাস ও ভবিষ্যৎ।

তিনি আদিবাসী মেক্সিকান ঐতিহ্যকে সম্মান করতেন।

রিভেরা মেক্সিকোর প্রাচীন সভ্যতা যেমন অ্যাজটেক ও মায়া সংস্কৃতি থেকে অনুপ্রাণিত হন।

তাঁর দেয়ালচিত্রে ঐতিহাসিক ও পৌরাণিক চরিত্রের পাশাপাশি সাধারণ মানুষও স্থান পায়।

তিনি মনে করতেন শিল্প সমাজ পরিবর্তনের হাতিয়ার।

তাঁর চিত্রকর্মে মেক্সিকোর সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্যের প্রতিবাদ ফুটে উঠেছে।

তিনি বিশ্বাস করতেন, সত্যিকারের শিল্প হতে হবে জনগণের জন্য।

রিভেরা একাধিক রাজনৈতিক সংগঠনের সদস্য ছিলেন।

১৯২০-এর দশকে তিনি কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন।

পরবর্তীতে মতভেদে কিছুদিনের জন্য দল থেকে বহিষ্কৃত হন।

তাঁর শিল্পে সর্বদা শ্রমিকদের মর্যাদা ও শক্তি প্রকাশ পায়।

তিনি রঙ ব্যবহারে সাহসী ও প্রতীকী ছিলেন।

প্রায়ই উজ্জ্বল লাল, হলুদ, নীল ব্যবহার করে সামাজিক বার্তা দেন।

তাঁর মুরালে বিশাল আকারের মানবচিত্র দেখা যায়।

এই আকারগুলো মানুষের শক্তি ও একাত্মতার প্রতীক।

তিনি চিত্রে যান্ত্রিক উপাদান এবং প্রযুক্তির প্রতিফলন দেখাতে পছন্দ করতেন।

তাঁর অনেক কাজেই শিল্প ও প্রকৃতির মিলন ঘটেছে।

তিনি “Man at the Crossroads” মুরালটির মাধ্যমে মানুষ ও প্রযুক্তির ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন তোলেন।

১৯৪০-এর দশকে রিভেরা আন্তর্জাতিক খ্যাতি অর্জন করেন।

তিনি তখন লাতিন আমেরিকার সবচেয়ে প্রভাবশালী শিল্পী হিসেবে পরিচিত হন।

তাঁর কাজ UNESCO, মার্কিন শিল্প জাদুঘর, ও বিশ্বজুড়ে প্রদর্শিত হয়েছে।

তিনি ১৯৪০ সালে সান ফ্রান্সিসকোতে “Pan American Unity” মুরাল সম্পন্ন করেন।

এই মুরালে তিনি আমেরিকার ঐক্য ও সংস্কৃতির বৈচিত্র্য দেখিয়েছেন।

রিভেরার কাজ মেক্সিকোর শিক্ষা ও শিল্পনীতিতে গভীর প্রভাব ফেলে।

তিনি বিশ্বাস করতেন, শিল্প শিক্ষা প্রতিটি শিশুর প্রাথমিক অধিকার।

রিভেরা শিশুদের জন্যও চিত্র আঁকতেন।

তিনি শিল্পে ইতিহাসকে জীবন্ত করে তুলতেন।

তাঁর কাজ মেক্সিকোর জাতীয় পরিচয়ের অংশ হয়ে ওঠে।

তাঁর শিল্পচিন্তা আজও মেক্সিকোর দেয়ালে বেঁচে আছে।

রিভেরা জীবদ্দশায় ২০০০-এর বেশি পেইন্টিং ও শতাধিক মুরাল তৈরি করেন।

তাঁর প্রতিটি দেয়ালচিত্র রাজনৈতিক ভাষ্যের মতো।

তিনি প্রায়ই নিজেকে চিত্রে অন্তর্ভুক্ত করতেন—“স্ব-প্রতিকৃতি” আকারে।

ফ্রিদা কাহলোও তাঁর বহু মুরালে উপস্থিত ছিলেন।

রিভেরা তাঁর শিল্পের মাধ্যমে নারীশক্তিকে সম্মান জানিয়েছেন।

তিনি বিশ্বাস করতেন নারী সমাজের রূপান্তরের কেন্দ্রে থাকে।

তাঁর শিল্পের মাধ্যমে শ্রমিক, কৃষক, নারী, শিশু—সবাই কণ্ঠস্বর পায়।

তিনি শিল্পের মাধ্যমে ইতিহাস পুনর্লিখন করতে চেয়েছেন।

তাঁর “History of Mexico” মুরালটি সেই প্রচেষ্টার অন্যতম উদাহরণ।

এই মুরালটি মেক্সিকো সিটির ন্যাশনাল প্যালেসে অবস্থিত।

এতে স্পেনীয় উপনিবেশ থেকে বিপ্লব ও আধুনিক যুগ পর্যন্ত পুরো ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছে।

তিনি একাধিক জীবনী ও স্মৃতিকথা লিখেছেন।

“My Art, My Life” তাঁর আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ।

এতে তিনি তাঁর শিল্প-দর্শন ও জীবনের অভিজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন।

তিনি বহু তরুণ শিল্পীর মেন্টর হিসেবে কাজ করেছেন।

রিভেরা বিশ্বাস করতেন যে, একজন শিল্পীর সামাজিক দায়িত্ব আছে।

তিনি শিল্পের গণতান্ত্রিক রূপে বিশ্বাসী ছিলেন।

তাঁর জীবনযাপন ছিল বিপ্লবী, চিন্তাধারা ছিল গভীর।

তিনি তাঁর সময়ের সামাজিক ন্যায়বিচারের জন্য আওয়াজ তুলেছিলেন।

রিভেরা ও ফ্রিদা দুজনেই একে অপরকে গভীরভাবে অনুপ্রাণিত করেন।

তাদের সম্পর্ক মেক্সিকান শিল্প ও সংস্কৃতিতে এক কিংবদন্তি হয়ে আছে।

জীবনের শেষ দিকে তাঁর শরীর দুর্বল হয়ে পড়ে।

তিনি ক্যানসারে আক্রান্ত হন।

১৯৫৭ সালের ২৪ নভেম্বর তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

মৃত্যুর সময় তাঁর বয়স ছিল ৭০ বছর।

তাঁকে মেক্সিকো সিটির “Rotonda de los Hombres Ilustres”-এ সমাধিস্থ করা হয়।

মেক্সিকো তাঁকে “জাতীয় ধন” হিসেবে ঘোষণা করে।

তাঁর মৃত্যুর পরও তাঁর কাজ নতুন প্রজন্মের শিল্পীদের অনুপ্রেরণা হয়ে আছে।

রিভেরার শিল্প সমাজ ও ইতিহাসের এক স্থায়ী দলিল।

তিনি প্রমাণ করেছেন—শিল্প কেবল রূপ নয়, এটি প্রতিবাদের ভাষা।

আজও তাঁর দেয়ালচিত্রগুলো মেক্সিকোর আত্মা ও জনগণের সংগ্রামের কণ্ঠস্বর হয়ে প্রতিধ্বনিত হয়।