Rembrandt van Rijn

Rembrandt van Rijn

রেমব্রান্টের পূর্ণ নাম রেমব্রান্ট হার্মেনসজুন ভ্যান রেইন (Rembrandt Harmenszoon van Rijn)।

তিনি জন্মগ্রহণ করেন ১৫ জুলাই, ১৬০৬ সালে নেদারল্যান্ডসের লাইডেন (Leiden) শহরে।

তাঁর পিতার নাম ছিল হার্মেন গেরিটজুন ভ্যান রেইন, যিনি একজন ময়দা কলের মালিক ছিলেন।

মায়ের নাম নেইল্টগেন উইলেন্সডটার ভ্যান জুইটব্রুক, যিনি ছিলেন ধর্মপ্রাণ গৃহিণী।

রেমব্রান্ট ছিলেন পরিবারের নবম সন্তান।

তিনি প্রথমে লাইডেন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন, কিন্তু পড়াশোনা শেষ করেননি।

শৈশব থেকেই তাঁর আঁকার প্রতি প্রবল আগ্রহ ছিল।

প্রথমে তিনি চিত্রশিল্পী জ্যাকব ভ্যান সোয়ানেনবার্গ (Jacob van Swanenburgh)-এর কাছে প্রশিক্ষণ নেন।

পরবর্তীতে তিনি বিখ্যাত চিত্রশিল্পী পিটার লাস্টম্যান (Pieter Lastman)-এর অধীনে পড়াশোনা করেন।

লাস্টম্যান তাঁর শিক্ষক হিসেবে রেমব্রান্টের বর্ণনাশক্তি ও আলোছায়া ব্যবহারে গভীর প্রভাব ফেলেন।

প্রাথমিক জীবনে রেমব্রান্ট মূলত বাইবেলিক দৃশ্য ও ঐতিহাসিক চিত্র আঁকতেন।

১৬২৫ সালে তিনি নিজস্ব কর্মশালা স্থাপন করেন।

শিষ্যদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন বিখ্যাত চিত্রশিল্পী গেরিট ডু (Gerrit Dou)।

রেমব্রান্ট ১৬৩১ সালে আমস্টারডামে চলে আসেন, যেখানে তাঁর খ্যাতি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।

তিনি বাণিজ্যিক ও সামাজিক শ্রেণির জন্য পোর্ট্রেট (Portrait) আঁকতে শুরু করেন।

১৬৩৪ সালে তিনি সাস্কিয়া ভ্যান ইউলেনবার্গ (Saskia van Uylenburgh)-এর সঙ্গে বিবাহ করেন।

সাস্কিয়া ছিলেন এক ধনী ব্যবসায়ীর আত্মীয়া।

তাঁদের দাম্পত্য জীবন অত্যন্ত সুখের ছিল, যদিও চার সন্তানের মধ্যে মাত্র একজন বেঁচে ছিলেন — টিটাস।

সাস্কিয়া ১৬৪২ সালে যক্ষ্মায় মারা যান।

এই মৃত্যুর ফলে রেমব্রান্ট মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন।

সাস্কিয়ার মৃত্যুর বছরেই তিনি আঁকেন তাঁর সর্বাধিক বিখ্যাত চিত্র — “The Night Watch”।

এই চিত্রটির আসল নাম ছিল “The Company of Captain Frans Banning Cocq”।

“The Night Watch” ছিল এক বিশাল দলীয় প্রতিকৃতি, যেখানে আলোক-ছায়ার নাটকীয় ব্যবহার ছিল অতুলনীয়।

তাঁর আলোক ব্যবহারকে বলা হয় Chiaroscuro (কিয়ারোস্কুরো) — আলো-অন্ধকারের নাটকীয় সংমিশ্রণ।

রেমব্রান্টের চিত্রে আলো প্রায়ই প্রতীকী অর্থ বহন করে।

তিনি চিত্রে মানুষের অন্তর্দেশীয় অনুভূতি প্রকাশে পারদর্শী ছিলেন।

তাঁর মুখাবয়বের গভীর চিন্তন, দুঃখ, বিশ্বাস ও ভয় প্রকাশে তাঁর তুলনাহীন দক্ষতা ছিল।

রেমব্রান্ট প্রায় ৯০টিরও বেশি স্ব-প্রতিকৃতি (Self-portrait) এঁকেছিলেন।

এসব স্ব-প্রতিকৃতি তাঁর জীবনের পরিবর্তন, বয়স, দুঃখ, আনন্দ ও আত্মদর্শনের সাক্ষ্য দেয়।

তাঁর স্ব-প্রতিকৃতিগুলো ইউরোপীয় শিল্প ইতিহাসে অন্যতম শ্রেষ্ঠ আত্মজীবনীমূলক রেকর্ড।

রেমব্রান্ট ছিলেন একজন দক্ষ এচিং শিল্পী (Etcher)।

তিনি প্রায় ৩০০টিরও বেশি এচিং ও প্রিন্ট তৈরি করেছিলেন।

তাঁর প্রিন্টগুলো আলোক-ছায়া ও মানসিক গভীরতায় অনন্য।

রেমব্রান্ট প্রায়ই সাধারণ মানুষের জীবন, বৃদ্ধ, ভিক্ষুক, ও বাইবেলিক চরিত্র নিয়ে কাজ করতেন।

তিনি “The Anatomy Lesson of Dr. Nicolaes Tulp (1632)” চিত্রটির জন্য বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন।

এটি ছিল তাঁর প্রথম বড় পাবলিক কমিশন।

“The Anatomy Lesson” চিত্রে বিজ্ঞানের প্রতি শ্রদ্ধা ও মানুষের বুদ্ধিবৃত্তিক অনুসন্ধানের চিত্র ফুটে ওঠে।

১৬৩০ থেকে ১৬৪৫ সালের মধ্যে তাঁর কাজের সোনালি যুগ ধরা হয়।

তাঁর স্টুডিওতে বহু শিক্ষার্থী ও সহকারী কাজ করতেন।

তিনি শিক্ষার্থীদের স্বাধীনভাবে কাজ করতে উৎসাহ দিতেন।

সাস্কিয়ার মৃত্যুর পর তিনি গৃহপরিচারিকা গিয়ার্টজে ডির্ক্স (Geertje Dircx)-এর সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলেন।

পরবর্তীতে তিনি গিয়ার্টজের সঙ্গে বিবাদে জড়িয়ে পড়েন।

পরে তিনি আরেক নারী হেনড্রিক্জে স্টোফেলস (Hendrickje Stoffels)-এর সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করেন।

হেনড্রিক্জে ও রেমব্রান্টের একটি কন্যা সন্তান হয় — করনেলিয়া।

আর্থিক দিক থেকে রেমব্রান্ট খুব শৃঙ্খলাবদ্ধ ছিলেন না।

তিনি বিলাসী জীবনযাপন করতেন, শিল্পসামগ্রী ও প্রাচীন নিদর্শন সংগ্রহে প্রচুর অর্থ ব্যয় করতেন।

১৬৫৬ সালে তাঁর আর্থিক দেউলিয়া ঘোষণা করা হয়।

তাঁর বাড়ি ও সংগ্রহ আদালতের নির্দেশে বিক্রি করা হয়।

এই ঘটনাগুলো তাঁর জীবনের গভীর কষ্টের প্রতিফলন ঘটায়।

তবুও তিনি আঁকা বন্ধ করেননি — বরং আরও গভীর, মানবিক চিত্র সৃষ্টি করেন।

দেউলিয়ার পর তিনি আমস্টারডামের রোজেনগ্রাখট (Rozengracht) এলাকায় বাস করতেন।

তাঁর ছেলে টিটাস ও হেনড্রিক্জে তাঁকে আর্থিকভাবে সাহায্য করতেন।

টিটাস ও হেনড্রিক্জে দুজনেই পরে মারা যান, যা রেমব্রান্টের জন্য এক বিরাট আঘাত।

জীবনের শেষ দিকে তাঁর আঁকা চিত্র আরও গম্ভীর, সংযত ও আত্মবিশ্লেষণধর্মী হয়ে ওঠে।

শেষ জীবনে তিনি মূলত বাইবেলিক বিষয় ও স্ব-প্রতিকৃতি আঁকতেন।

তাঁর বিখ্যাত পরবর্তী কাজগুলোর মধ্যে আছে “The Jewish Bride” ও “Syndics of the Drapers’ Guild”।

“The Jewish Bride” চিত্রে ভালোবাসা ও মানবিকতার মৃদু আবেগ প্রকাশ পেয়েছে।

“Syndics” চিত্রে দলীয় চরিত্রের মধ্যে ব্যক্তিত্বের সূক্ষ্ম প্রকাশ দেখা যায়।

তিনি মানুষের আত্মার গভীর আলো খুঁজে বের করতেন।

তাঁর চিত্রে বাহ্যিক সৌন্দর্যের চেয়ে অন্তর্দেশীয় সত্যই মুখ্য।

রেমব্রান্টের ব্যবহৃত রঙ ছিল গভীর ও মাটির টোনে সমৃদ্ধ।

তিনি ঘন ব্রাশস্ট্রোক ও টেক্সচার ব্যবহার করতেন।

তাঁর কাজের মধ্যে আলো যেন কোনো এক আধ্যাত্মিক উৎস থেকে উদ্ভাসিত হয়।

তাঁর রঙের প্যালেটে ব্রাউন, গোল্ড, ও ওকার প্রধান ভূমিকা রাখে।

তাঁর ক্যানভাসে মুখের অভিব্যক্তি সূক্ষ্ম অথচ শক্তিশালী।

রেমব্রান্ট ছিলেন এক নিঃসঙ্গ ও আত্মমগ্ন শিল্পী।

জীবনের শেষ দিকে তিনি খুবই গরিব অবস্থায় ছিলেন।

৪ অক্টোবর, ১৬৬৯ সালে তিনি আমস্টারডামে মৃত্যুবরণ করেন।

তাঁকে Westerkerk গির্জার নামহীন কবরে সমাহিত করা হয়।

মৃত্যুর পরই তাঁর শিল্পের প্রকৃত মর্যাদা বিশ্বে স্বীকৃতি পায়।

রেমব্রান্টকে বলা হয় “আলো ও আত্মার চিত্রশিল্পী”।

তাঁর কাজ মানবিক সহানুভূতি, দার্শনিক গভীরতা ও অন্তর্দর্শনে পূর্ণ।

তিনি ইউরোপীয় বারোক যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রতিনিধি।

তাঁর প্রভাব দেখা যায় ভেলাসকেজ, গয়া, ভ্যান গঘ, ও রেনোয়ার-এর কাজে।

১৮তম শতকে তাঁর কাজ নতুনভাবে পুনরাবিষ্কৃত হয়।

১৯শ শতকে Romantic painters তাঁকে মানবিক প্রতিভার প্রতীক হিসেবে দেখেন।

আজ তাঁর কাজ বিশ্বের প্রায় প্রতিটি বড় জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে।

আমস্টারডামের Rijksmuseum-এ তাঁর বহু মাস্টারপিস রয়েছে।

“The Night Watch” আজও সেই জাদুঘরের প্রধান আকর্ষণ।

লাইডেনে তাঁর জন্মভিটে এখন Rembrandt House Museum নামে পরিচিত।

রেমব্রান্ট কেবল চিত্রশিল্পী নয়, তিনি একজন অসাধারণ শিক্ষকও ছিলেন।

তাঁর কাছ থেকে শিক্ষা নিয়ে বহু শিল্পী বিশ্বখ্যাত হন।

তাঁর স্টাইল অনেকবার অনুকৃত হয়েছে, কিন্তু কখনোই সমতুল্য হয়নি।

রেমব্রান্ট নিজের আত্মার সঙ্গে ক্রমাগত সংলাপ চালিয়েছেন তাঁর ক্যানভাসে।

তিনি শিল্পকে কেবল রূপ নয়, অন্তর সত্যের প্রকাশ হিসেবে দেখতেন।

তাঁর চিত্রে বাস্তবতা ও আধ্যাত্মিকতা একীভূত হয়েছে।

রেমব্রান্টের শিল্পে সময়ের গতিপ্রকৃতি ও মানবজীবনের অনিত্যতা প্রতিফলিত।

তাঁর কাজ দর্শককে অন্তর্দৃষ্টি ও অনুভবের গভীরে নিয়ে যায়।

রেমব্রান্টের শিল্প আধুনিক মনোবিজ্ঞানের সূক্ষ্ম উপলব্ধিকে পূর্বাভাস দেয়।

তিনি নিজের ব্যর্থতা ও কষ্টকেও সৌন্দর্যে রূপান্তরিত করেছিলেন।

রেমব্রান্টের নাম আজ শিল্পের মানবিক দিকের প্রতীক।

তাঁর প্রতিটি চিত্র মানব জীবনের এক একটি স্তবক।

তিনি প্রমাণ করেছেন, আলো-ছায়ার মধ্যে লুকিয়ে আছে আত্মার ভাষা।

তাঁর কলমে ও ব্রাশে ফুটে ওঠে করুণা, শ্রদ্ধা ও মমতা।

শিল্প সমালোচকরা তাঁকে “Painter of Pain and Light” বলে অভিহিত করেছেন।

রেমব্রান্টের জীবনীতে সাফল্য ও ট্র্যাজেডি পাশাপাশি চলে।

তিনি নিজের জীবনকে ক্যানভাসে অঙ্কিত করেছেন নির্ভয়ে ও সত্যভাবে।

রেমব্রান্টের কাজ আজও আলোকচিত্র, চলচ্চিত্র ও মনোবিজ্ঞান গবেষণায় অনুপ্রেরণা দেয়।

তিনি নেদারল্যান্ডসের সর্বশ্রেষ্ঠ চিত্রশিল্পী হিসেবে বিবেচিত।

শিল্প ইতিহাসে রেমব্রান্ট চিরকাল মানব আত্মার আলো ও অন্ধকারের মহান কবি হিসেবে অমর।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top