এমিলি ডিকিনসন: নীরবতার দীপশিখা ও আমেরিকান কবিতার অদ্বিতীয় রহস্য

এমিলি ডিকিনসন

বিশ্বসাহিত্যের ইতিহাসে এমন খুব কম ঘটনাই আছে যা এমিলি ডিকিনসনের কাব্য-আবিস্কারের মতো বিস্ময়কর এবং নাটকীয়। জীবদ্দশায় যিনি ছিলেন নিভৃতচারী, লোকচক্ষুর অন্তরালে থাকা এক নারী, মৃত্যুর পর তাঁর হাত ধরেই আমেরিকান কবিতার মোড় ঘুরে গিয়েছিল। ১৮৮৬ সালে এমিলির মৃত্যুর চার বছর পর, ১৮৯০ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর কবিতার প্রথম সংকলন, যার সহজ নাম ছিল ‘Poems’ (পোয়েমস)। এই গ্রন্থটি কেবল একটি বই ছিল না; এটি ছিল এক দীর্ঘ নীরবতার অবসান এবং এক যুগান্তকারী ও মেধাবী কবির আত্মপ্রকাশ। ১৮৯০ সালের এই সংকলনটি এমিলি ডিকিনসনকে বিশ্ববাসীর কাছে পরিচয় করিয়ে দেয়, যদিও সেই পরিচয় ছিল কিছুটা অসম্পূর্ণ এবং সম্পাদিত। আজকের এই প্রবন্ধে আমরা আলোচনা করব ১৮৯০ সালের সেই ঐতিহাসিক প্রকাশনা, তার প্রেক্ষাপট, বিষয়বস্তু, সম্পাদনার বিতর্ক এবং বাংলা সাহিত্যের পাঠকের কাছে এর গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে।

১. প্রেক্ষাপট: আমহার্স্টের নিভৃতচারী কবি
এমিলি ডিকিনসন (১৮৩০-১৮৮৬) আমেরিকার ম্যাসাচুসেটসের আমহার্স্টে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর জীবদ্দশায় খুব সামান্য সংখ্যক কবিতাই (সম্ভবত দশটির কম) বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল এবং সেগুলোও ছিল নামবিহীন অবস্থায়। তিনি তাঁর জীবনের শেষ কয়েক দশক বাড়ির সীমানার বাইরে পা রাখেননি। সাদা পোশাক পরতেন এবং বাইরের জগতের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করতেন কেবল চিঠিপত্রের মাধ্যমে।

কিন্তু এই বাহ্যিক নীরবতার আড়ালে তাঁর মনের ভেতরে চলছিল এক প্রচণ্ড সৃজনশীল ঝড়। তিনি গোপনে লিখেছিলেন প্রায় ১৮০০-র মতো কবিতা। ছোট ছোট কাগজের টুকরোয়, খামের পেছনে বা হাতে সেলাই করা ছোট পুস্তিকায় (যাকে ‘ফ্যাসিকেল’ বা Fascicle বলা হয়) তিনি এই কবিতাগুলো লিখে নিজের কাঠের সিন্দুকে জমিয়ে রাখতেন।

১৮৮৬ সালে এমিলির মৃত্যুর পর তাঁর ছোট বোন লাভিনিয়া ডিকিনসন সেই সিন্দুক খুলে কবিতার এই বিশাল ভান্ডার আবিষ্কার করেন। লাভিনিয়া বুঝতে পেরেছিলেন যে তাঁর দিদি সাধারণ কোনো মানুষ ছিলেন না, তিনি ছিলেন এক অসাধারণ প্রতিভার অধিকারী। লাভিনিয়ার জেদ এবং প্রচেষ্টাতেই এমিলির কবিতাগুলো প্রকাশের আলো দেখেছিল।

২. ১৮৯০ সালের ‘পোয়েমস’ প্রকাশনা এবং সম্পাদনা
এমিলির কবিতাগুলো প্রকাশ করা সহজ কাজ ছিল না। তাঁর হাতের লেখা ছিল দুর্বোধ্য, যতিচিহ্নের ব্যবহার ছিল অদ্ভুত (প্রচুর ড্যাশ বা হাইফেনের ব্যবহার), এবং ব্যাকরণ বা ছন্দের প্রথাগত নিয়ম তিনি মানতেন না। সমসাময়িক প্রকাশকদের কাছে এই কবিতাগুলো ছিল “বড্ড বেশি আধুনিক” এবং “অমার্জিত”।

লাভিনিয়া প্রথমে এমিলির ঘনিষ্ঠ বান্ধবী এবং ভ্রাতৃবধূ সুসান ডিকিনসনের কাছে যান, কিন্তু সুসান সম্পাদনার কাজে খুব ধীরগতিতে এগোচ্ছিলেন। অধৈর্য হয়ে লাভিনিয়া তখন মেবল লুমিস টড (Mabel Loomis Todd)-এর শরণাপন্ন হন। মেবল ছিলেন এমিলির ভাই অস্টিনের প্রেমিকা এবং একজন প্রতিভাবান লেখিকা। মেবলের সাথে যুক্ত হন এমিলির দীর্ঘদিনের পত্রবন্ধু এবং সাহিত্য সমালোচক টমাস ওয়েন্টওয়ার্থ হিগিনসন (Thomas Wentworth Higginson)।

মেবল লুমিস টড এবং টি.ডব্লিউ. হিগিনসন মিলে ১৮৯০ সালের প্রথম সংকলনটি প্রস্তুত করেন। এই সংকলনটিতে মোট ১১৫টি কবিতা স্থান পেয়েছিল। তবে এই প্রকাশনার পেছনে একটি বড় বিতর্ক রয়েছে যা সাহিত্য সমালোচকরা আজও আলোচনা করেন।

সম্পাদনার বিতর্ক: ‘শুদ্ধিকরণ’ নাকি ‘বিকৃতি’?
১৮৯০ সালের সংকলনটি এমিলির মূল কবিতার হুবহু প্রতিলিপি ছিল না। হিগিনসন এবং টড মনে করেছিলেন, এমিলির কবিতাগুলো সাধারণ পাঠকের কাছে দুর্বোধ্য মনে হতে পারে। তাই তাঁরা কবিতাগুলোকে “মার্জিত” বা “মসৃণ” করার চেষ্টা করেছিলেন। তারা যা যা পরিবর্তন করেছিলেন:

যতিচিহ্ন পরিবর্তন: এমিলি তাঁর কবিতায় প্রচুর ড্যাশ (—) ব্যবহার করতেন, যা তাঁর আবেগের বিরতি বা চিন্তার অসম্পূর্ণতা বোঝাত। সম্পাদকরা এই ড্যাশগুলো সরিয়ে কমা, সেমিকোলন বা দাড়ি বসিয়েছিলেন।

ছন্দ ও মিল: এমিলি প্রায়ই ‘স্ল্যান্ট রাইম’ (Slant Rhyme) বা অপূর্ণ মিল ব্যবহার করতেন। সম্পাদকরা অনেক ক্ষেত্রে শব্দ পরিবর্তন করে প্রথাগত অন্ত্যমিল বা ‘পারফেক্ট রাইম’ তৈরি করেছিলেন।

শিরোনাম: এমিলি তাঁর কবিতার কোনো শিরোনাম দিতেন না। ১৮৯০ সালের সংকলনে সম্পাদকরা প্রতিটি কবিতার বিষয়বস্তু অনুযায়ী শিরোনাম জুড়ে দিয়েছিলেন (যেমন: ‘The Chariot’, ‘A Service of Song’ ইত্যাদি)।

ব্যাকরণ: এমিলির নিজস্ব ব্যাকরণরীতিকে পাল্টে প্রমিত ইংরেজি ব্যাকরণ অনুযায়ী সাজানো হয়েছিল।

আধুনিক সমালোচকদের মতে, এই সম্পাদনা এমিলির কবিতার মৌলিকত্ব নষ্ট করেছিল। কিন্তু একথাও সত্য যে, ১৮৯০ সালে যদি এই পরিবর্তনগুলো না করা হতো, তবে হয়তো তৎকালীন রক্ষণশীল পাঠকসমাজ এমিলিকে গ্রহণই করত না। হিগিনসন এবং টডের এই “সহজীকরণ”-এর কারণেই এমিলি দ্রুত জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন।

৩. ১৮৯০ সালের সংকলনের গঠন ও বিষয়বস্তু
১৮৯০ সালের ‘পোয়েমস’ বইটি চারটি প্রধান বিভাগে বিভক্ত ছিল। এই বিভাজনটি সম্পাদকরাই করেছিলেন, কিন্তু এটি এমিলির চিন্তাজগৎকে বুঝতে সাহায্য করে। বিভাগগুলো হলো:

জীবন (Life)

প্রেম (Love)

প্রকৃতি (Nature)

সময় ও অনন্তলোক (Time and Eternity)

নিচে এই বিভাগগুলোর বিস্তারিত আলোচনা করা হলো:

ক. জীবন (Life)
এই বিভাগে এমিলির জীবনদর্শন, সাফল্য, ব্যর্থতা এবং মানুষের অস্তিত্বের সংকট নিয়ে লেখা কবিতাগুলো স্থান পায়। এই বিভাগের সবচেয়ে বিখ্যাত কবিতাগুলোর মধ্যে একটি হলো “Success is counted sweetest”। ১৮৯০ সালের সংস্করণে এটি ব্যাপক প্রশংসা পায়। এখানে কবি বলছেন, যারা জীবনে জয়ী হয়, তারা জয়ের প্রকৃত স্বাদ বোঝে না; বরং যে পরাজিত হয়ে মৃত্যুবরণ করছে, সেই বিজয়ের আসল মূল্য অনুধাবন করতে পারে।

আরেকটি উল্লেখযোগ্য কবিতা হলো “I’m Nobody! Who are you?”। এটি এমিলির কৌতুকপ্রিয় এবং নিভৃতচারী সত্তার এক অনন্য দলিল। তিনি খ্যাতি বা পরিচিতি চান না, তিনি ‘কেউ না’ হয়েই থাকতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। তিনি লিখেছেন:

“How dreary to be somebody! / How public, like a frog…”

খ. প্রেম (Love)
এমিলি ডিকিনসন আজীবন অবিবাহিত ছিলেন, কিন্তু তাঁর কবিতার প্রেম ছিল গভীর, তীব্র এবং অনেক ক্ষেত্রে আধ্যাত্মিক। ১৮৯০ সালের বইটিতে প্রেমের কবিতাগুলো শরীরী প্রেমের চেয়ে বিচ্ছেদ, অপেক্ষা এবং আত্মত্যাগের কথাই বেশি বলে। তাঁর প্রেম অনেক সময় ঈশ্বরের প্রতি ভক্তির সাথে মিশে একাকার হয়ে গেছে। তিনি প্রেমকে দেখেছিলেন এমন এক শক্তি হিসেবে যা মৃত্যুকেও অতিক্রম করতে পারে।

গ. প্রকৃতি (Nature)
এমিলি ডিকিনসনকে সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রকৃতিপ্রেমী কবি বলা হয়। কিন্তু তাঁর প্রকৃতি ওয়ার্ডসওয়ার্থ বা রবীন্দ্র-প্রকৃতির মতো সবসময় শান্ত বা স্নিগ্ধ নয়। তাঁর প্রকৃতি রহস্যময়, কখনো কখনো নিষ্ঠুর এবং সর্বদা বিস্ময়কর। ১৮৯০ সালের সংকলনে প্রকৃতির ক্ষুদ্রতম উপাদান—একটি পাখি, একটি মৌমাছি, বা এক ফালি রোদ—অসামান্য গুরুত্ব পেয়েছে।

যেমন, “A Bird came down the Walk” কবিতায় তিনি একটি পাখির ক্রিয়াকলাপ এত নিখুঁতভাবে বর্ণনা করেছেন যা সিনেমাটোগ্রাফিক মনে হয়। পাখিটি পোকা খাচ্ছে, ভয়ে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে—এই দৃশ্যগুলো এমিলির সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণ ক্ষমতার প্রমাণ দেয়।

ঘ. সময় ও অনন্তলোক (Time and Eternity)
এই বিভাগটিই সম্ভবত এমিলি ডিকিনসনের কবিতার সবচেয়ে শক্তিশালী অংশ। মৃত্যু এবং মৃত্যু-পরবর্তী জীবন নিয়ে তাঁর মতো এত গভীর এবং বিচিত্র চিন্তা খুব কম কবিই করেছেন। তাঁর কাছে মৃত্যু কোনো ভীতিকর দানব নয়, বরং এক শান্ত ভদ্রলোক (Gentleman Caller)।

এই বিভাগের শ্রেষ্ঠ কবিতা, এবং সম্ভবত এমিলির জীবনেরও শ্রেষ্ঠ কবিতা—”Because I could not stop for Death” (১৮৯০ সালে এর শিরোনাম দেওয়া হয়েছিল ‘The Chariot’)। এই কবিতায় তিনি মৃত্যুকে এক প্রেমিকের সাথে তুলনা করেছেন, যে ঘোড়ার গাড়ি নিয়ে তাঁকে নিতে এসেছে। তারা ধীরে ধীরে স্কুলের পাশ দিয়ে, শস্যক্ষেতের পাশ দিয়ে অনন্তের দিকে যাত্রা করছে।

“Because I could not stop for Death – / He kindly stopped for me –”

৪. কাব্যশৈলী: প্রথার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ
১৮৯০ সালের পাঠকরা এমিলির কবিতার বিষয়বস্তুতে মুগ্ধ হলেও, তাঁর শৈলী নিয়ে বেশ বিভ্রান্ত ছিলেন। এমিলি প্রথাগত ভিক্টোরিয়ান কবিতার নিয়ম ভাঙচুর করেছিলেন।

সংক্ষিপ্ততা: তাঁর কবিতাগুলো ছিল অত্যন্ত ছোট ও আঁটসাঁট। তিনি অপ্রয়োজনীয় শব্দ ব্যবহার করতেন না। একে বলা হয় “Compression” বা ঘনীভবন।

চিত্রকল্প (Imagery): তিনি বিমূর্ত ধারণাকে মূর্ত রূপ দিতেন। যেমন, “Hope is the thing with feathers” (আশা হলো পালকযুক্ত এক পাখি)।

ছন্দ: তিনি চার্চের স্তবগান বা ‘Hymn Meter’-এর আদলে কবিতা লিখতেন। এটি সাধারণ মানুষের কাছে পরিচিত ছিল, কিন্তু কবিতার ক্ষেত্রে এই ছন্দের ব্যবহার ছিল অভিনব।

৫. ১৮৯০ সালে অভ্যর্থনা ও সমালোচনা
১৮৯০ সালের নভেম্বরে রবার্টস ব্রাদার্স (Roberts Brothers) থেকে বইটি প্রকাশিত হওয়ার পর অদ্ভুত এক ঘটনা ঘটে। প্রকাশক এবং সম্পাদকরা ভেবেছিলেন বইটি হয়তো খুব একটা চলবে না। কিন্তু প্রকাশের কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই প্রথম সংস্করণ নিঃশেষ হয়ে যায়। পরের দুই বছরে বইটির ১১টি সংস্করণ বের করতে হয়েছিল।

তৎকালীন সমালোচকদের প্রতিক্রিয়া ছিল মিশ্র। কেউ কেউ তাঁর ব্যাকরণ এবং ছন্দের ‘ভুল’ নিয়ে কঠোর সমালোচনা করেছিলেন। যেমন, লন্ডন ডেইলি নিউজ লিখেছিল, এমিলির কবিতাগুলো “ব্যাকরণহীন এবং ছন্দহীন”। কিন্তু সাধারণ পাঠকরা এবং উইলিয়াম ডিন হাওয়েলসের (William Dean Howells) মতো প্রভাবশালী সাহিত্যিকরা এমিলির প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিলেন। হাওয়েলস লিখেছিলেন, এই কবিতাগুলোর বহিরাবরণ হয়তো অমসৃণ, কিন্তু এর আত্মা অত্যন্ত শক্তিশালী। তিনি এমিলির কবিতাকে তুলনা করেছিলেন এমন এক ফলের সাথে যার খোসা শক্ত ও খসখসে, কিন্তু ভেতরটা রসে টলটলে।

১৮৯০-এর এই সাফল্য প্রমাণ করেছিল যে, পাঠকরা নতুন এবং সত্য কিছু খুঁজছিল, যা তৎকালীন কৃত্রিম সাহিত্যের ভিড়ে এমিলি দিতে পেরেছিলেন।

৬. বাংলা সাহিত্যে ও পাঠকের কাছে প্রাসঙ্গিকতা
এমিলি ডিকিনসনের কবিতা বাঙালি পাঠকের কাছে বিশেষভাবে আবেদন তৈরি করতে পারে, কারণ তাঁর ভাবনার সাথে আমাদের রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং জীবনানন্দ দাশের বেশ মিল পাওয়া যায়।

রবীন্দ্রনাথ ও এমিলি: রবীন্দ্রনাথের ‘গীতাঞ্জলি’র আধ্যাত্মিকতা এবং মৃত্যুচেতনার সাথে এমিলির ‘Time and Eternity’ অংশের কবিতার গভীর মিল রয়েছে। রবীন্দ্রনাথ যেমন মৃত্যুকে ‘শ্যামল ছায়া’ বা বন্ধুরূপে দেখেছেন, এমিলিও মৃত্যুকে দেখেছেন এক শান্ত পথপ্রদর্শক হিসেবে। উভয়েই প্রকৃতির মাঝে ঈশ্বরের অস্তিত্ব অনুভব করেছেন।

জীবনানন্দ ও এমিলি: অন্যদিকে, এমিলির একাকীত্ব, বিষণ্ণতা এবং পরাবাস্তব চিত্রকল্পের সাথে জীবনানন্দ দাশের কবিতার সুর মিলে যায়। জীবনানন্দ যেমন ঘাস, শিশির, পেঁচা বা ইঁদুরের মতো তুচ্ছ জিনিসকে মহিমান্বিত করেছেন, এমিলিও তেমনি মাছি, মাকড়সা বা এক টুকরো পাথরকে কবিতার বিষয় করেছেন। এমিলির “I felt a Funeral, in my Brain” কবিতাটির মানসিক যন্ত্রণার সাথে জীবনানন্দের ‘বোধ’ বা মনোজাগতিক কবিতার মিল স্পষ্ট।

৭. ১৮৯০ থেকে আজকের এমিলি: এক বিবর্তন
১৮৯০ সালের ‘পোয়েমস’ এমিলি ডিকিনসনকে পরিচিতি দিয়েছিল ঠিকই, কিন্তু তাঁকে পুরোপুরি চেনা যায়নি। ১৯৫৫ সালে যখন টমাস এইচ. জনসন (Thomas H. Johnson) এমিলির কবিতার সম্পূর্ণ এবং অবিকৃত সংস্করণ (The Complete Poems of Emily Dickinson) প্রকাশ করেন, তখনই বিশ্ববাসী এমিলির আসল রূপ দেখতে পায়। তখন বোঝা যায়, ১৮৯০ সালে টড এবং হিগিনসন কীভাবে তাঁর কবিতাগুলো বদলে দিয়েছিলেন।

আজ আমরা এমিলির সেই ‘অমসৃণ’ ছন্দ এবং ড্যাশযুক্ত কবিতাগুলোকেই বেশি মূল্য দিই। আমরা বুঝতে পারি, ওই ড্যাশগুলো নিছক ভুল ছিল না, সেগুলো ছিল আধুনিক কবিতার শ্বাস-প্রশ্বাস। তবুও, ১৮৯০ সালের সংকলনটির ঐতিহাসিক গুরুত্ব অপরিসীম। টড এবং হিগিনসন যদি তখন ওই ‘মার্জিত’ সংস্করণটি প্রকাশ না করতেন, তবে হয়তো এমিলি ডিকিনসন চিরকাল সিন্দুকের অন্ধকারেই থেকে যেতেন। সেই বইটি ছিল একটি সেতু, যা ১৯-শতকের রক্ষণশীল পাঠককে ২০-শতকের আধুনিকতার দিকে নিয়ে গিয়েছিল।

১৮৯০ সালে প্রকাশিত এমিলি ডিকিনসনের ‘পোয়েমস’ বিশ্বসাহিত্যের এক অবিস্মরণীয় ঘটনা। এটি কেবল একজন নারীর কবিতা সংকলন নয়, এটি মানুষের অন্তরের গভীরতম অনুভূতির এক দলিল। একাকীত্ব, প্রেম, প্রকৃতি এবং মৃত্যু নিয়ে এমিলির এই কবিতাগুলো দেশ ও কালের সীমানা পেরিয়ে আজও আমাদের নাড়া দেয়।

এমিলি লিখেছিলেন, “This is my letter to the World / That never wrote to Me” (এটি আমার চিঠি সেই পৃথিবীর কাছে, যে আমাকে কখনো লেখেনি)। ১৮৯০ সালে সেই চিঠি পৃথিবীর হাতে পৌঁছায়, এবং পৃথিবী আজও সেই চিঠির উত্তর দিয়ে যাচ্ছে বিস্ময় ও ভালোবাসার সাথে। বাংলা ভাষাভাষী পাঠকের কাছেও এই চিঠি এক অমূল্য সম্পদ, যা আমাদের শেখায় কীভাবে চার দেয়ালের মাঝে থেকেও অনন্তের সাথে কথা বলা যায়। এমিলি ডিকিনসন প্রমাণ করেছেন, দেখার জন্য চোখের চেয়ে অন্তর্দৃষ্টির প্রয়োজন বেশি, আর ভ্রমণের জন্য পায়ের চেয়ে কল্পনার ডানা অনেক বেশি শক্তিশালী।

১৮৯০ সালের সংকলনের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য কবিতার ভাবানুবাদ
প্রবন্ধের পূর্ণতা দানের জন্য ১৮৯০ সালের সংকলনের কয়েকটি বিখ্যাত কবিতার মূল ভাব এবং প্রাসঙ্গিকতা নিচে উল্লেখ করা হলো:

১. Because I could not stop for Death (কারণ আমি মৃত্যুর জন্য থামতে পারিনি) এই কবিতায় কবি দেখিয়েছেন, জীবনের ব্যস্ততায় আমরা মৃত্যুর কথা ভাবি না। কিন্তু মৃত্যু তার নিজস্ব সময়মতো আসে। এখানে মৃত্যু কোনো ভয়ানক কঙ্কাল নয়, সে ভদ্রবেশী। সে কবিকে তার গাড়িতে তুলে নেয়। গাড়িতে আছেন আরেকজন যাত্রী—’অমরত্ব’ (Immortality)। এই যাত্রা জীবনের বিভিন্ন পর্যায় (শৈশব, যৌবন, বার্ধক্য) পেরিয়ে অনন্তের দিকে এগিয়ে যায়।

২. Success is counted sweetest (সাফল্য তাদের কাছেই সুমিষ্ট) যারা সবসময় জয়ী হয়, তারা জয়ের প্রকৃত তৃষ্ণা অনুভব করতে পারে না। যে সৈনিক যুদ্ধক্ষেত্রে পরাজিত হয়ে, তৃষ্ণার্ত বুকে মৃত্যুবরণ করছে এবং দূর থেকে বিজয়ের ধ্বনি শুনছে—কেবল সেই জানে জয়ের আসল মানে কী। বঞ্চনার মাধ্যমেই প্রাপ্তির প্রকৃত মূল্য বোঝা যায়—এটিই এই কবিতার মূল উপজীব্য।

৩. There is no Frigate like a Book (বইয়ের মতো কোনো জাহাজ নেই) এমিলি ডিকিনসন আজীবন ঘরবন্দি ছিলেন, কিন্তু তাঁর মন ঘুরে বেড়াত সারা বিশ্বে। এই কবিতায় তিনি বলেছেন, দূরে কোথাও যাওয়ার জন্য বইয়ের চেয়ে ভালো কোনো জাহাজ নেই। দরিদ্র মানুষও এই বাহনে চড়ে ভ্রমণের আনন্দ নিতে পারে, কারণ এতে কোনো টোল বা ভাড়া লাগে না। এটি মানুষের আত্মিক মুক্তির এক ইশতেহার।

এমিলি ডিকিনসন ১৮৮৬ সালে মারা গেলেও, ১৮৯০ সালে ‘পোয়েমস’ প্রকাশের মাধ্যমে তাঁর পুনর্জন্ম হয়। এই বইটি প্রমাণ করে যে, প্রকৃত শিল্পকলা কখনো হারিয়ে যায় না। সিন্দুকের অন্ধকারে লুকিয়ে রাখা ফ্যাসিকেলগুলো আজ বিশ্বসাহিত্যের উজ্জ্বল নক্ষত্র। ১৮৯০ সালের সেই ছোট বইটিই ছিল সেই বিস্ফোরণ, যার শব্দ আজও আমরা শুনতে পাই।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top