– সৈয়দ হৃদয়
অন্ধকার নদীর বুক দিয়ে যখন একা একটি নৌকা ভেসে যায়, তখন তার কাঁপা-কাঁপা ছায়া জলের তলে হারানো কোনো এক আত্মার প্রতিফলন হয়ে ওঠে। মনে হয়, মানুষ নামের এক সত্তা নিজের দিশাহারা নৌকাকে নিয়ন্ত্রণ করতে করতে অদৃশ্য স্রোতের সাথে গা মেলাচ্ছে, সেই স্রোত মানুষকে ভেতরের আলো থেকে বিচ্ছিন্ন করে বাধ্য করে অন্ধকারের ঢেউয়ে ভেসে যেতে—এ যেন তার বিবেকের নির্বাসন।
নির্বাসিত বিবেকের এই স্রোতেই মানুষ হারায় তার আলোকিত দিশা। তার প্রতিটি পদক্ষেপ হয়ে ওঠে অন্ধকারের ঢেউয়ের সাথে লড়াই। কারণ বিবেক হচ্ছে মানুষের অস্তিত্বের সূর্য। এটি ছাড়া মানুষ হলো চাঁদহীন রাত্রি, দিকহীন মরুভূমি, কিংবা হাড়হীন দেহ।
মানুষের আত্মা যদি একটি নগরী হয়, তবে তার সবচেয়ে উঁচু প্রাসাদটির নাম হবে বিবেক। সেই প্রাসাদই নির্ধারণ করে নগরীর আলোকমালা জ্বলবে কি না, নাকি তা অন্ধকারে ডুবে যাবে। কল্পনা করুন, একদিন হঠাৎ সেই প্রাসাদ ভেঙে পড়ে। আলো নিভে যায়। শহরটি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। মানুষ তখনও হাঁটে, শ্বাস নেয়, হাসে, খায়—কিন্তু তার ভেতরের প্রাসাদ যখন নির্বাসনে, তখন সে কি সত্যিই মানুষ থাকে? নাকি কেবল ছদ্মবেশী এক প্রাণী, যার দেহে মানুষের আকৃতি আছে, কিন্তু আত্মা নেই? অদ্ভুত এক পরিহাস হলো—এই মানুষের চোখ থাকে, কিন্তু তখন আর সত্য দেখতে পারে না; কান থাকে, কিন্তু ন্যায় শুনতে পারে না; জিহ্বা থাকে, কিন্তু সত্য উচ্চারণ করে না। অর্থাৎ সে এক প্রকার দৃষ্টিহীন, শ্রবণহীন ও বোবা সত্তায় রূপ নেয়। তার বুদ্ধি তীক্ষ্ণ হতে পারে, কিন্তু সেই বুদ্ধি তখন হয়ে ওঠে ধ্বংসের যন্ত্র।
প্রশ্ন জাগে, কেন মানুষ তার বিবেক নির্বাসনে পাঠায়? এর মনস্তত্ত্ব গভীর। মানুষ যখন ভোগে, ক্ষমতায়, অহংকারে মগ্ন হয়ে যায়, তখন বিবেককে বিরক্তিকর মনে হয়। বিবেক বারবার তাকে সতর্ক করে: “এটা অন্যায়”, “ওটা নিষ্ঠুর”, “এভাবে চললে বিপদ আসবে।” কিন্তু মানুষ তার স্বার্থের নেশায় এতটাই অন্ধ হয়ে পড়ে যে, সে বিবেককে চুপ করাতে চায়। প্রথমে সে বিবেককে উপেক্ষা করে, পরে তাকে শৃঙ্খলিত করে, আর শেষে নির্বাসনে পাঠিয়ে দেয়। এই নির্বাসনের ফল হলো—মানুষের ভেতরে জন্ম নেয় এক ভয়ঙ্কর শূন্যতা। সে তখন আর নিজের কাছে দায়বদ্ধ থাকে না। আর তখনই সভ্যতা অমানবিক হয়।
মানুষকে যদি কেবল জৈবিক কাঠামোতে বিচার করা হয়, তবে সে গরু বা কুকুরের চেয়ে ভিন্ন কিছু নয়। মানুষকে মানুষ করে তোলে তার বিবেক। এই বিবেকই আমাদের বলে দেয়, আমরা কোন পথে হাঁটব, কোন সিদ্ধান্ত মানবিক, কোনটি অমানবিক। যখন সেই শক্তি নির্বাসনে যায়, তখন মানুষ দেখতে মানুষ হলেও, ভেতরে সে পরিণত হয় অমানবিক শূন্যতায়। তখন স্বাধীন মানুষ আসলে দাসে পরিণত হয়—লোভ, হিংসা, ক্ষমতালিপ্সা ও নিষ্ঠুরতার দাসে। তখন মানুষ হত্যা করে কিন্তু অপরাধবোধ পায় না। তখন দুর্নীতি করে কিন্তু মনে করে এটি তার বুদ্ধিমত্তার প্রমাণ। তখন মিথ্যা বলে কিন্তু ভাবে, এটি কৌশল। তখন পরকীয়া করে কিন্তু যুক্তি দাঁড় করায় সংস্কৃতি কিংবা সমাজসেবা নামে। তখন প্রশ্ন ওঠে— যে মানুষ তার মানবিক বোধ হারিয়েছে, সে কি মানুষ, নাকি কেবল ‘জীবন্ত মৃত’? একারণেই বিবেককে বলা যায় মানুষের অন্তরাত্মার আলো। এটি ঠিক এক বাতিঘরের মতো, যা উত্তাল ঝড়ে দিশাহারা জাহাজকে নিরাপদে পৌঁছে দেয় বন্দরে। যদি সেই বাতিঘরের আলো নিভে যায়, তবে জাহাজগুলো অন্ধকার সমুদ্রে ভেসে বেড়ায়, দিশাহারা হয়ে ভেঙে পড়ে পাথরে। মানুষও তেমনি—যখন তার বিবেক নির্বাসনে যায়, তখন সে নিজের অস্তিত্বের সমুদ্রেই ভেঙে পড়ে, অথচ তা টের পায় না।
বিবেক হলো মানুষের ভেতরের আদালত। সে আদালত যখন তালাবদ্ধ হয়, তখন মানুষ হয়ে ওঠে ‘অপরাধী’ অথচ সে ‘নির্দোষের মুখোশ’ পরে ঘুরে বেড়ায়। বিবেকহীন মানুষ স্বপ্ন দেখে ক্ষমতার, অথচ সেই ক্ষমতা ভেঙে ফেলে মানবিক সম্পর্ক। তখন শিক্ষক শিক্ষা দেয় না, সে কেবল জ্ঞান বিক্রি করে। ডাক্তার সেবা করে না, ব্যবসা করে জীবন নিয়ে। বিচারক ন্যায় প্রতিষ্ঠা করে না, টাকার কাছে নত হয়। রাজনীতিবিদ নেতৃত্ব দেয় না, কেবল শোষণ চালায়। এ যেন এক বিরাট শ্মশান, যেখানে জীবন্ত মানুষরা ঘুরে বেড়ায়, কিন্তু প্রত্যেকেই মৃত বিবেকের কঙ্কাল।
তবুও প্রশ্ন থেকে যায়—এই নির্বাসন কি চিরস্থায়ী? না, মানুষের ভেতরে বিবেককে ফেরত আনার পথ আছে। যেভাবে শীতের দীর্ঘ অন্ধকার শেষে সূর্য ওঠে, তেমনি বিবেকও ফিরে আসতে পারে মানুষের অন্তরে। কিন্তু শর্ত একটাই—মানুষকে চাইতে হবে সত্য, ন্যায় ও মানবিকতার আলো। বিবেককে ফিরিয়ে আনার অর্থ হলো, নিজের স্বার্থের বাইরে দাঁড়িয়ে অন্যের ব্যথা অনুভব করা। এটি হলো আত্মার পরিশুদ্ধি, নৈতিকতার পুনর্জন্ম। যে সমাজ বিবেককে সম্মান করে, সেই সমাজেই প্রকৃত মানুষ তৈরি হয়।


















