লেখক – তেইশ

বিগ ম্যাজিক: ক্রিয়েটিভ লিভিং বিয়ন্ড ফিয়ার বইতে এলিজাবেথ গিলবার্ট সৃজনশীলতার প্রকৃতি এবং কীভাবে ভয়কে পরাস্ত করে সৃষ্টিশীল শক্তিকে গ্রহণ করা যায় তা ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি নিজের অভিজ্ঞতা, অনুপ্রেরণামূলক গল্প এবং ব্যবহারিক পরামর্শ দিয়ে দেখিয়েছেন যে, সৃজনশীল জীবনযাপন করার জন্য আমাদের কীভাবে মনোভাব গঠন করা উচিত।

প্রধান বিষয়বস্তু ও শিক্ষা

  1. সৃজনশীলতা একটি রহস্যময় শক্তি
     গিলবার্ট বিশ্বাস করেন যে সৃজনশীল ধারণাগুলো জীবন্ত সত্তার মতো, যা একজন মানুষের সহযোগিতা চায়। যদি কেউ একটি ধারণাকে গ্রহণ করে, তবে তা তার সাথে কাজ করবে। কিন্তু যদি কেউ এটিকে উপেক্ষা করে বা প্রত্যাখ্যান করে, তবে ধারণাটি অন্য কারও কাছে চলে যেতে পারে।
  2. ভয়কে জয় করা
     সৃজনশীল যাত্রায় ভয় সবসময়ই থাকবে, তবে এটি আমাদের সিদ্ধান্তগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। গিলবার্ট ভয়কে স্বীকার করতে বলেন, তবে এটিকে কখনই আমাদের সৃজনশীল পথচলার নিয়ন্ত্রণ নিতে দেওয়া উচিত নয়। তিনি মজার উপমা দেন যে, ভয় গাড়ির যাত্রী হতে পারে, কিন্তু কখনোই চালকের আসনে বসতে পারবে না।
  3. সৃষ্টি করার জন্য অনুমতির প্রয়োজন নেই
     অনেক মানুষ মনে করেন যে সৃজনশীল কিছু করার জন্য তাদের অনুমতি বা স্বীকৃতি দরকার। গিলবার্ট বলেন, প্রত্যেকেরই সৃষ্টিশীল হওয়ার অধিকার রয়েছে, তা জনপ্রিয়তা বা সাফল্যের ওপর নির্ভর করে না। সৃজনশীল কাজ তার নিজের মূল্য রাখে, এটি শুধুমাত্র আর্থিক বা সামাজিক স্বীকৃতির জন্য নয়।
  4. কঠোর পরিশ্রম বনাম কষ্ট সহ্য করা
     প্রচলিত ধারণা হলো, ভালো শিল্প সৃষ্টি করতে হলে কষ্ট পেতে হয়। গিলবার্ট এই ধারণার বিরোধিতা করেন এবং আনন্দ ও কৌতূহল নিয়ে সৃষ্টিশীল কাজে এগিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন। তিনি বলেন, কৌতূহলই সাফল্যের মূল চাবিকাঠি হতে পারে।
  5. ফলাফলের প্রতি অতিরিক্ত মনোযোগ না দেওয়া
     সৃজনশীল কাজের ফলাফল যদি শুধুমাত্র খ্যাতি বা অর্থের সাথে যুক্ত থাকে, তবে এটি আমাদের কাজের আনন্দ কমিয়ে দেয়। তিনি পরামর্শ দেন যে, সৃষ্টিশীল মানুষদের উচিত ফলাফল সম্পর্কে চিন্তা না করে কেবল কাজ করে যাওয়া এবং সৃষ্টিশীলতাকে উপভোগ করা।
  6. অনুপ্রেরণার প্রতি বিশ্বাস রাখা
     অনুপ্রেরণা সবসময় সরাসরি আসে না, এটি অনিয়মিত ও অপ্রত্যাশিতভাবে আসে। গিলবার্ট বলেন, সৃষ্টিশীল মানুষদের উচিত খোলা মন নিয়ে কাজ করা, ধৈর্য ধরে থাকা, এবং যখনই অনুপ্রেরণা আসে, তখন তা কাজে লাগানো।
  7. “ট্রিকস্টার” বনাম “শহীদ” দৃষ্টিভঙ্গি
     গিলবার্ট দুটি মনোভাবের মধ্যে পার্থক্য দেখিয়েছেন—
    1. শহীদ (Martyr): যারা সৃষ্টিশীল কাজকে কষ্ট ও ত্যাগের সাথে যুক্ত করে, তাদের জন্য সৃজনশীলতা একটি বোঝা হয়ে ওঠে।
    1. প্রতারক (Trickster): যারা সৃষ্টিশীলতাকে হালকা, মজাদার এবং খেলাধুলার মতো উপভোগ করে।
       তিনি প্রতারকের (Trickster) দৃষ্টিভঙ্গিকে সমর্থন করেন, যেখানে মানুষ সহজভাবে ও মজার ছলে সৃষ্টিশীল কাজ করে যেতে পারে।

শেষ কথা

বিগ ম্যাজিক বইটি একটি অনুপ্রেরণামূলক এবং বাস্তবমুখী গাইড যা যে কেউ সৃজনশীল কাজে আত্মবিশ্বাস অর্জন করতে চাইলে সাহায্য করতে পারে। গিলবার্টের সহজ ভাষা, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা এবং অনুপ্রেরণামূলক দর্শন বইটিকে অত্যন্ত উপভোগ্য করে তুলেছে। তিনি পাঠকদের ভয় কাটিয়ে সৃজনশীল কাজকে আনন্দের সাথে গ্রহণ করার পরামর্শ দেন।

“Big Magic: Creative Living Beyond Fear” – বিস্তারিত অধ্যায়ভিত্তিক বিশ্লেষণ

লেখক এলিজাবেথ গিলবার্ট তার বই Big Magic কে ছয়টি অধ্যায়ে ভাগ করেছেন, যেখানে তিনি সৃজনশীলতার বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করেছেন। প্রতিটি অধ্যায়ে তিনি বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতা, অনুপ্রেরণামূলক গল্প এবং কার্যকর পরামর্শ দিয়েছেন, যা পাঠকদের তাদের সৃষ্টিশীলতা বিকাশে সাহায্য করবে।

অধ্যায় ১: সাহস (Courage)

মূল ভাবনা:

সৃজনশীল জীবনযাপন করতে হলে সাহস দরকার। ভয় সবসময় থাকবে, তবে এটি যেন আমাদের কাজের পথে বাধা না হয়ে দাঁড়ায়।

মূল শিক্ষা:

  • সৃজনশীল হতে গেলে ভয়কে স্বীকার করতে হবে, তবে এটিকে আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে দেওয়া যাবে না।
  • ভয় কখনও সম্পূর্ণ দূর হয় না, তাই এটি সঙ্গে থাকবে—তবে আমরা চাইলে এটিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারব।
  • গিলবার্ট তার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিয়ে বলেন, কীভাবে তিনি নিজেও তার লেখালেখির ক্যারিয়ারে ভয়ের সম্মুখীন হয়েছিলেন, কিন্তু কখনও ভয়ের কারণে থেমে যাননি।

অধ্যায় ২: জাদু (Enchantment)

মূল ভাবনা:

সৃজনশীলতার মধ্যে একধরনের রহস্যময় জাদু আছে, যা আমাদের জীবনকে অর্থবহ করে তোলে।

মূল শিক্ষা:

  • লেখকের মতে, ধারণাগুলো জীবন্ত এবং তারা আমাদের কাছে আসে। যদি আমরা সেগুলোর প্রতি খেয়াল না রাখি, তাহলে তারা অন্য কারও কাছে চলে যায়।
  • অনুপ্রেরণা যে কোনো সময় আসতে পারে, তাই আমাদের সবসময় প্রস্তুত থাকতে হবে।
  • এখানে একটি গল্প আছে যেখানে গিলবার্ট ব্যাখ্যা করেন, কীভাবে তিনি একটি বই লেখার পরিকল্পনা করেছিলেন কিন্তু পরে দেখলেন সেই একই ধারণা আরেকজন লেখকের মাধ্যমে বাস্তবায়িত হয়েছে!

অধ্যায় ৩: অনুমতি (Permission)

মূল ভাবনা:

সৃজনশীল কাজ করার জন্য আমাদের কারও অনুমতির প্রয়োজন নেই।

মূল শিক্ষা:

  • সমাজ থেকে অনুমতি পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করলে অনেক সৃজনশীল মানুষ তাদের প্রতিভা নষ্ট করে ফেলে।
  • আমাদের মনে রাখা দরকার যে, শিল্পচর্চা করা আমাদের অধিকার।
  • গিলবার্ট বলেন, “তুমি শিল্প তৈরি করতে চাও? তাহলে করো! এটা করার জন্য তোমার কোনো প্রমাণ বা ডিগ্রির প্রয়োজন নেই।”
  • তিনি রোজি নামে এক মহিলার গল্প শেয়ার করেন, যিনি ৮০ বছর বয়সে স্কেটিং শিখতে শুরু করেন, শুধুমাত্র কারণ তিনি এটি ভালোবাসতেন!

অধ্যায় ৪: অধ্যবসায় (Persistence)

মূল ভাবনা:

সাফল্যের জন্য প্রতিভার চেয়ে অধ্যবসায় বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

মূল শিক্ষা:

  • প্রতিটি শিল্পী কখনো না কখনো ব্যর্থতার সম্মুখীন হয়। কিন্তু সফল হতে গেলে কাজ চালিয়ে যেতে হবে।
  • গিলবার্ট তার নিজের লেখক জীবনের উদাহরণ দিয়ে ব্যাখ্যা করেছেন, কীভাবে তিনি বারবার প্রত্যাখ্যাত হওয়া সত্ত্বেও লিখে গেছেন এবং শেষ পর্যন্ত সফল হয়েছেন।
  • তিনি বলেন, “তুমি যদি সত্যি তোমার কাজ ভালোবাসো, তাহলে কঠিন সময়েও তা চালিয়ে যাবে।”

অধ্যায় ৫: আস্থা (Trust)

মূল ভাবনা:

সৃজনশীলতাকে খুব বেশি গুরুতরভাবে না নিয়ে বরং এর প্রতি ভালোবাসা ও বিশ্বাস রেখে কাজ করা উচিত।

মূল শিক্ষা:

  • শিল্পচর্চার ক্ষেত্রে ‘ভুক্তভোগীর মানসিকতা’ (Martyr Mindset) বাদ দিয়ে মজার দৃষ্টিভঙ্গি নেওয়া উচিত।
  • অনেক মানুষ মনে করে, শিল্পচর্চা করতে গেলে কষ্ট পেতে হবে—গিলবার্ট এই ধারণার বিরোধিতা করেন।
  • তিনি বলেন, “তুমি কি জীবনভর ভুগতে চাও নাকি মজা করতে চাও?”
  • এখানে তিনি “Trickster vs. Martyr” দৃষ্টিভঙ্গির কথা বলেন—একজন শহীদ (Martyr) কষ্ট করে শিল্প তৈরি করে, কিন্তু একজন চালাক (Trickster) এটি আনন্দের সাথে করে।

অধ্যায় ৬: ঐশ্বরিক শক্তি (Divinity)

মূল ভাবনা:

সৃজনশীলতা একটি ঐশ্বরিক উপহার, যা আমাদের সকলের ভেতরে আছে এবং এটি আমাদের উদযাপন করা উচিত।

মূল শিক্ষা:

  • শিল্পচর্চা করতে গেলে ঈশ্বরপ্রদত্ত প্রতিভার ওপর বিশ্বাস রাখতে হবে।
  • সৃজনশীলতা কেবলমাত্র পেশা নয়, এটি আনন্দের জন্যও করা যেতে পারে।
  • সৃজনশীল কাজে যোগ দিলে আমাদের জীবন আরও অর্থপূর্ণ হয়ে ওঠে।

চূড়ান্ত শিক্ষা ও উপসংহার:

📌 ভয় থাকবে, তবে এটিকে আমাদের নিয়ন্ত্রণ করতে দেওয়া যাবে না।
 📌 সৃষ্টিশীল ধারণাগুলো আমাদের কাছে আসে, তবে আমাদের সেগুলোকে গ্রহণ করতে হবে।
 📌 আমাদের কাজ করার জন্য অন্য কারও অনুমতির দরকার নেই।
 📌 সফল হতে হলে অধ্যবসায় থাকতে হবে।
 📌 সৃষ্টিশীলতা কষ্টের কিছু নয়, এটি মজার বিষয় হতে পারে।
 📌 আমাদের সৃষ্টিশীল ক্ষমতাকে উপভোগ করতে হবে এবং এটিকে অতিরিক্ত গুরুতরভাবে নেওয়া উচিত নয়।

🎨 বইটি কাদের জন্য উপযুক্ত?

  • যারা সৃজনশীল কাজ (লেখালেখি, শিল্প, সংগীত, ফটোগ্রাফি, অভিনয় ইত্যাদি) করতে চান কিন্তু ভয়ের কারণে শুরু করতে পারছেন না।
  • যারা সৃজনশীল কাজে আগ্রহী, কিন্তু ব্যর্থতার ভয় পান।
  • যারা অন্যের অনুমতি বা স্বীকৃতি ছাড়া নিজেদের সৃজনশীলতার প্রকাশ ঘটাতে চান।
  • যারা সফল হওয়ার জন্য প্রতিভার চেয়ে অধ্যবসায়কে বেশি গুরুত্ব দিতে চান।

“Big Magic” শুধু সৃজনশীল কাজের জন্য নয়, এটি জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আমাদের মুক্তভাবে বাঁচার এবং নিজের ভয়কে জয় করার কথা বলে। এলিজাবেথ গিলবার্টের ভাষা সহজ, গল্পগুলো অনুপ্রেরণামূলক এবং বইটির প্রতিটি অধ্যায় আমাদের সৃষ্টিশীল জীবনযাপন করার নতুন দৃষ্টিভঙ্গি দেয়।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top