লেখক – ত্রিশ

হঠাৎ করে উপন্যাস লেখার উন্মাদনা

ক্রিস বাটি রচিত No Plot? No Problem! মূলত লেখার প্রতি ভীতি বা দ্বিধা কাটিয়ে ওঠার একটি অনুপ্রেরণাদায়ক ম্যানুয়াল। বাটি হলেন ন্যাশনাল নভেল রাইটিং মান্থ (NaNoWriMo)-এর প্রতিষ্ঠাতা। তিনি দেখিয়েছেন যে উপন্যাস লেখার পথে সবচেয়ে বড় বাধা “প্রতিভার অভাব” বা “সময় সঙ্কট” নয়; বরং সেটি হল আমাদের নিজের ব্যর্থতার ভয় ও নিখুঁত কিছু করার বাসনা। এই বইটি এক মাসের (বিশেষত ৩০ দিনের) মধ্যে ৫০,০০০ শব্দের খসড়া উপন্যাস লেখার কর্মসূচির মধ্য দিয়ে পাঠকদের আহ্বান জানায়। মূল উদ্দেশ্য হলো দ্রুততা, এবং ধারাবাহিকতা বজায় রেখে সৃজনশীলতাকে উন্মুক্ত করা।

বইয়ের শিরোনাম itself—No Plot? No Problem!—ইঙ্গিত করে যে আপনার কাছে নিখুঁত কাহিনি বা চরিত্রের সুস্পষ্ট নকশা না থাকলেও কোনো সমস্যা নেই। লিখতে শুরু করে দিন; রহস্যময়ভাবে দেখবেন চরিত্র, দৃশ্য ও ঘটনা যেন নিজেরাই প্রকাশ পায়। একমাসের মধ্যে ৫০,০০০ শব্দ লেখার এই পরিকল্পনাকে বাটি তুলনা করেন এক ধরনের “সৃজনশীল অ্যাডভেঞ্চার” হিসেবে। তাঁর বক্তব্য, যদি প্রতিদিন নির্দিষ্ট সংখ্যক শব্দ লেখার লক্ষ্য রাখেন এবং এ সময় সমালোচনামূলক মনটিকে সাময়িকভাবে স্থগিত রাখেন, তাহলে লেখার মধ্যেই অপ্রত্যাশিত আনন্দ ও লেখকের পরিচয় খুঁজে পাবেন। এই দ্রুত-লেখার সময়ে যা যা ভুল হবে, বা খসড়া যে বিশৃঙ্খল হবে, সেগুলো পরে সম্পাদনার সময়ে ঠিক করা যাবে। প্রথম খসড়ায় তিনি সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেন গতি এবং ধারাবাহিকতাকে।

ন্যানো রাইটিং ম্যারাথনের উত্পত্তি দ্রুততায় সাফল্য

প্রথম অধ্যায়ে বাটি ব্যাখ্যা করেছেন কিভাবে তাঁর বন্ধুদের ছোট্ট দলটি ১৯৯৯ সালে প্রথমবারের মতো “৫০,০০০ শব্দ ৩০ দিনে” চ্যালেঞ্জ শুরু করে। তারা সিদ্ধান্ত নেয় যে, গল্প বা চরিত্রের সুস্পষ্ট পরিকল্পনা না থাকলেও মানসম্মত কিছু লেখার অজুহাতে বসে না থেকে, দ্রুত লিখে ফেলা হবে।

পাঠকরা জানতে পারেন, কীভাবে এই প্রচণ্ড গতি লেখকদের এমন এক অবস্থায় নিয়ে যায় যেখানে তারা সমালোচনামূলক মনকে থামিয়ে স্রেফ লিখতে বাধ্য হয়। যে আতঙ্ক সাধারণত “ভুল” লেখার ভয়ে পঙ্গু করে দেয়, সেই ভয়কে বাটি সচেতনভাবে উপেক্ষা করতে বলেন। গতি বাড়লে আপনার “ইনার ক্রিটিক” বা অন্তর্নিহিত সমালোচক যথেষ্ট সময়ই পাবে না আপনার সৃজনশীলতাকে ধ্বংস করার। বরং অনবরত লেখার চাপে গল্পের নানা অজানা কোণ ও প্লট মোড় নিজেদের মতো করে বেরিয়ে আসতে পারে।

এ অধ্যায়ের মূল বক্তব্য হলো, ৩০ দিনে ৫০,০০০ শব্দের লক্ষ্যটি যথেষ্ট বড়সড়, কিন্তু অসম্ভব নয়। এতে একদিকে লেখক নিজের সামর্থ্যের ওপর বিশ্বাস স্থাপন করতে পারেন, অন্যদিকে সীমিত সময়সীমার কারণে বাড়তি উত্সাহ ও উত্তেজনাও তৈরি হয়। লেখার কাজটিকে “দীর্ঘস্থায়ী পরিশ্রম” না ভেবে, বরং “নির্ধারিত ছোট সময়ে উচ্চগতির সৃজনশীল অভিযান” হিসেবে বিবেচনা করাই হল বাটির মূল টিপস।

পরিমাণ বনাম গুণমান

দ্বিতীয় অধ্যায়ে বাটি আরো বিস্তারিতভাবে বোঝান কেন প্রথম খসড়ার ক্ষেত্রে গুণমানের থেকে পরিমাণকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া উচিত। বেশিরভাগ নতুন লেখকের সবচেয়ে বড় ভুল হলো লেখার সময়েই নিখুঁত করে ফেলার চেষ্টা করা। ফলে মাত্র কয়েকটি অনুচ্ছেদ লিখেই তাঁরা ফেঁসে যান; বাকিটা আর এগোয় না। বাটি এটাকে লেখকসুলভ “পারফেকশনিজম” বলে চিহ্নিত করেন। তিনি জোর দিয়ে বলেন, প্রথম খসড়া তোমার ঘামজড়ানো, অপরিণত ধারণাগুলোর মাঠ এটি নিখুঁত হতেই হবেএমনটি নয় বরং এটি বিদ্যমান থাকলেই যথেষ্ট

এই কারণে তিনি “রিভিশন” বা সম্পাদনা পর্বকে একেবারে শেষের জন্য রেখে দিতে বলেন। খসড়া চলাকালে প্রতিটি বাক্যের সৌন্দর্য বিচার করলে মূল গল্পের রক্ত-উত্তেজনা থেমে যায়। তাই লিখতে থাকুন—চলমান ভাবনাগুলোকে বাইরের কোনো রক্তচক্ষুর তোয়াক্কা না করে ঢেলে দিন। পৃষ্ঠা বা পর্দায় একগাদা শব্দ জড়ো করতে পারলে পরবর্তীতে পুরো গল্পের কাঠামো, চরিত্রায়ণ এবং ভাষা নিয়ে কাজ করা যায়।

সংখ্যার লক্ষ্য (যেমন ৫০,০০০ শব্দ) লেখকদের আরও একটি স্পষ্ট ও পরিমাপযোগ্য মানদণ্ড দেয়। প্রতিদিনের দৌড়ে আপনার অর্জন দৃশ্যমানভাবে বাড়তে থাকে, যা থেকে আপনি অনুপ্রেরণা পেতে থাকবেন। বাটির ভাষায়, লেখার গুণগত মান নিয়ে দুশ্চিন্তা করো পরের ধাপে, এখন শুধু পরিমাণ বাড়িয়ে চলো

প্রস্তুতিসময় নির্ধারণ, রিচ্যুয়াল সাপোর্ট সিস্টেম

তৃতীয় অধ্যায়ে বাটি এক মাসের এই ম্যারাথন লেখার জন্য কী কী প্রস্তুতি নিতে হবে, তা তুলে ধরেছেন। প্রথমেই আসে সময় ব্যবস্থাপনার প্রশ্ন। আমরা সবাই ব্যস্ত; কারো চাকরি আছে, কারো পরিবার, কারো বা পড়াশোনা। প্রতিদিন কীভাবে ১,৬৬৭ শব্দ (গড়ে ৫০,০০০ শব্দ ভাগ করলে) লিখবেন? বাটি বলেন, আপনাকে সৃজনশীলভাবে সময় বের করতে হবে। হতে পারে ভোরে ঘুম থেকে উঠে এক ঘণ্টা, দুপুরের বিরতিতে আধ ঘণ্টা, কিংবা রাতে পরিবারের সবাই ঘুমিয়ে পড়ার পর দুই ঘণ্টা।

এরপর আসে “লেখার রিচ্যুয়াল”—যেকোনো ছোট্ট কাজ যা মনকে লেখার অবস্থায় নিয়ে যায়। উদাহরণস্বরূপ, প্রতিবার লিখতে বসার আগে একটি বিশেষ গান চালানো, ধূপ জ্বালানো, কিংবা বিশেষ ধরনের চা বানিয়ে খাওয়া। এগুলো লেখার সাথেই একধরনের “লিঙ্কড সিগন্যাল” গড়ে তোলে যা মনকে দ্রুত আলোচ্য জগতে প্রবেশে সহায়তা করে।

সবশেষে তিনি সাপোর্ট সিস্টেমের ওপর জোর দেন। পরিবার, বন্ধু এবং সহকর্মীদের জানিয়ে দিন যে আপনি একটা পাগলামি অভিযানে নেমেছেন। তারা যেন বুঝতে পারে, আপনি এই সময়টায় কিছু সামাজিক আয়োজন থেকে বিরত থাকতে পারেন। পাশাপাশি, লেখালেখির বন্ধু থাকলে অসুবিধার মুহূর্তে “আমার আজ কোনো ধারণা আসছে না!” বলে তাদের সহায়তা চাওয়া যায়। একসাথে এগোলে চাপ কমে, আনন্দ বেড়ে যায়।

সরঞ্জাম, আউটলাইন, এবংঅনুপ্রেরণার মিথ

চতুর্থ অধ্যায়ে বাটি আলোচনা করেন কীভাবে লিখতে বসার আগে ন্যূনতম পরিকল্পনা—or এমনকি কোনো পরিকল্পনা ছাড়াই—শুরু করা যায়। বইয়ের শিরোনাম যতই বলুক “No Plot? No Problem!”, তবু কেউ কেউ চাইতেই পারেন প্রধান চরিত্র, কেন্দ্রিয় সংঘাত কিংবা প্রাথমিক প্লটের একটি রূপরেখা। তবে বাটি সতর্ক করেন যেন এই রূপরেখা তৈরি করতে গিয়ে বেশিদিন সময় নষ্ট না হয়। এক পৃষ্ঠার ধারণা বা কয়েকটি Stichpunkte থাকলেই যথেষ্ট।

প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের মধ্যে সর্বপ্রথম একটা নির্ভরযোগ্য ল্যাপটপ বা খাতা-কলম দরকার। দ্বিতীয়ত, পছন্দমতো জায়গায় লেখা ব্যাকআপ রাখতে হবে (যেমন ক্লাউড বা USB ড্রাইভ)। লেখার সময় “অনুপ্রেরণা” আসার অপেক্ষা না করে প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে লিখতে বসা—এটিই আসল কাঙ্খিত অভ্যাস। কারণ, বাটির মতে, অনুপ্রেরণা প্রায়শই কাজ শুরুর পরই আসে; আগে থেকে তাকে ডাকলে সে আসতে চায় না।

তিনি বলেন, উপন্যাস লেখার পেছনে একটামিস্টিকভাব প্রচলিত আছে, যেন বিশেষ নক্ষত্রের অবস্থান বা আলোকরশ্মি না পড়লে লেখা শুরু করা যায় না আসলে কাজ শুরু করলেই লেখার জাদু উন্মোচিত হবে প্রথমে ব্যর্থ শব্দ বেরোলেও ধীরে ধীরে দুর্দান্ত কিছু উঁকি দেবে

সপ্তাহ মধুচন্দ্রিমা পর্ব

লেখার মূল যাত্রা শুরু হলে বাটি পুরো ৩০ দিনকে চারটি সপ্তাহে ভাগ করে দেখান। পঞ্চম অধ্যায়ে তিনি বলেন, প্রথম সপ্তাহকে “হানিমুন স্টেজ” বা মধুচন্দ্রিমা পর্ব বলা যেতে পারে। এই সময়ে অধিকাংশ লেখকই প্রবল উদ্দীপনায় ভরে ওঠেন। নতুন চরিত্র, নতুন সেটিং, টাটকা আবেগ—সবকিছু মিলিয়ে লেখার সময়টা বেশ আনন্দদায়ক হয়।

এ পর্যায়ে অনেকে দৈনিক নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা থেকে বেশি লিখে ফেলেন। বাটি বলেন, এভাবে বেশি লিখতে আপত্তি নেই, তবে নিজেদের শক্তি বণ্টন করাও জরুরি। কারণ, মাত্র দু-তিন দিনে অতিরিক্ত পরিশ্রমে ক্লান্তি এসে গেলে দ্বিতীয় সপ্তাহে গিয়ে গতি ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়ে।

তিনি আরও পরামর্শ দেন এই সপ্তাহে আপনার সেরা লেখার সময় খুঁজে বের করতে। সকাল, দুপুর, সন্ধ্যা—কখন কলম (অথবা কীবোর্ড) বেশি সহজে চলে? কোথায় বসে লিখলে কম বিঘ্ন হয়—বাড়ি, কফিশপ, লাইব্রেরি নাকি পার্ক? এভাবে প্রথম সপ্তাহের উদ্বোধনী উচ্ছ্বাসকে ব্যবহার করে নিজের লেখার ধরণ ও অভ্যাস সম্পর্কে সচেতন হওয়া জরুরি। সেইসাথে, গল্পে অদ্ভুত চরিত্র বা ঘটনা যোগ করে দিন; এক মাসের লেখায় “আনন্দ” ধরে রাখাও কিন্তু কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।

সপ্তাহ ডুব এবং পুনরুদ্ধার

হানিমুন ফেজের পরই আসে সবচেয়ে কঠিন ধাপ: দ্বিতীয় সপ্তাহ, যা বাটি “দুই সপ্তাহের দুর্যোগ” বলেও অভিহিত করেন। কেন এই সময় দুর্যোগময়? কারণ প্রথম সপ্তাহের উচ্ছ্বাসটুকু কমতে থাকে। “নতুনত্বের মোহ” সরে গিয়ে আপনি টের পান গল্পের মধ্যে ছিদ্র বা নিস্তেজতা দেখা দিচ্ছে। গল্প বা চরিত্র জমছে না, নিজে হাঁপিয়ে যাচ্ছেন, কিংবা আশেপাশের মানুষের অযাচিত মন্তব্য বা অন্য কাজের চাপ এসে পড়ছে।

এই অবস্থায় সবচেয়ে বড় শত্রু হল আপনার “ইনার ক্রিটিক”—যে বলতে থাকে, “তোমার লেখা তো বাজে, চরিত্রগুলো ভিত্তিহীন, প্লটটা নির্বোধ।” বাটি অনুরোধ করেন, এই সময়েও যেন লেখার কাজ থামিয়ে না দেন। বরং যে দৃশ্য বা সংলাপ দুর্বল বা অগোছালো মনে হয়, সেগুলোকে পাশে টীকা দিয়ে চিহ্নিত করুন—“FIX LATER”—আর সামনের দিকে এগিয়ে যান।

দ্বিতীয় সপ্তাহ পেরোনোর জন্য বাটি কিছু টিপস দেন:

  1. প্লট নিনজা: হঠাৎ অপ্রত্যাশিত ঘটনাবলী ঢুকিয়ে দিন (উদাহরণস্বরূপ, রহস্যময় চিঠি, বিস্ফোরণ, নতুন শত্রু)।
  2. পরিবেশ বদল: অনেকক্ষণ ঘরে লিখতে থাকতে থাকতে যদি মনে হয় মাথা কাজ করছে না, একটা পার্কে বা ক্যাফেতে যান।
  3. বন্ধুদের সাপোর্ট: লেখা যখন আটকে যায়, NaNoWriMo ফোরাম বা স্থানীয় লেখকবন্ধুদের সাথে আলোচনা করুন, যাতে নতুন ধারণা পান।

মনে রাখবেন, Week 2 মূলত মানসিক পরীক্ষার সময়। একবার এই পর্যায়টা অতিক্রম করতে পারলে নিজেকে বিজয়ীর মতো লাগবে, কারণ আপনার অর্ধেক পথ পেরিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা উঁকি দিচ্ছে।

সপ্তাহ মাঝের প্রসার ছন্দ খুঁজে পাওয়া

তৃতীয় সপ্তাহে প্রবেশ করার সময় বেশ কিছু আকর্ষণীয় বিষয় ঘটে। প্রথম দিকে সব কিছু এলোমেলো মনে হলেও, ধীরে ধীরে বেশিরভাগ লেখকই এই পর্যায়ে এসে তাঁদের গল্পের ধাঁচটা ধরতে পারেন। চরিত্ররা যেন স্পষ্ট হতে শুরু করে, তাঁদের অতীত, উদ্দেশ্য, বাধা—সবগুলো বিষয় পরিস্কার হয়ে আসে।

বাটি বলেন, এই সপ্তাহে গল্পের “মধ্যভাগ”কে আরও সমৃদ্ধ করার দিকে মনোযোগ দিন। প্রায়ই দেখা যায়, উপন্যাসের শুরুটা উজ্জ্বল আর শেষ অংশটা নাটকীয় হয়, কিন্তু মাঝখানটা দুর্বল থেকে যায়। তাই চরিত্রগুলোর সম্পর্ককে আরও গভীর করুন, প্রধান সংকটটাকে ঘনিষ্ঠভাবে ফুটিয়ে তুলুন, কিংবা পার্শ্বচরিত্রকে একটা আলাদা সাবপ্লট দিন যাতে কাহিনিতে বৈচিত্র্য আসে।

এখন আপনার রুটিন কিছুটা স্থিতিশীল হয়ে গেছে বলে ধরে নেওয়া যায়। হয়তো জানেন, আপনি সন্ধ্যায় দুই ঘণ্টা টানা লিখতে পারেন বা ভোর ছয়টা থেকে সাতটার মধ্যে ৫০০ শব্দ লিখে ফেলতে পারেন। এই অভ্যাসটি চতুর্থ সপ্তাহে দারুণভাবে কাজে দেবে। তাছাড়া দুই সপ্তাহ পার করার পর আত্মবিশ্বাস বেড়ে যায়—“আমি এতদূর আসতে পেরেছি, সুতরাং বাকি পথটুকুও যাব।”

তৃতীয় সপ্তাহের মূলমন্ত্র: লেখার ছন্দ ধরা মধ্যভাগকে শক্তপোক্ত করা। একটু মন্থর মনে হলেও, এখানেই গল্পের ভিত্তি সম্পূর্ণভাবে দাঁড়ায়।

সপ্তাহ শেষ মুহূর্তের দৌড়

চতুর্থ সপ্তাহ বা শেষ ধাপ হল এক রকমের “উন্মত্ত দৌড়।” অনেকেই এই পর্যায়ে এসে দেখেন, শব্দসংখ্যা লক্ষ্য (৫০,০০০) পূরণে তারা কিছুটা পিছিয়ে আছে। অন্যদিকে, যাঁরা সামনের দিকে এগিয়ে ছিলেন, তাঁরাও টের পান গল্পকে একটা সমাপ্তিতে পৌঁছানো দরকার। বাটি বলেন, এই চাপটাই আপনার শত্রু নয়, বরং বন্ধু হতে পারে; কারণ শর্ট ডেডলাইনের চাপ মানুষকে অকল্পনীয়ভাবে পরিশ্রমী করে তোলে।

এ সময় তিনি কিছু কৌশল জানান:

  1. রাইটিং স্প্রিন্ট: ২০-৩০ মিনিটের জন্য যেকোনো বিঘ্ন (ইন্টারনেট, ফোন) বন্ধ করে নিশ্বাস না ফেলে শুধু লিখে যান। এরপর পাঁচ মিনিট বিরতি নিয়ে আবার শুরু করুন।
  2. ইন্টারনেট ব্লক: সোশ্যাল মিডিয়া বা ওয়েব ব্রাউজিং বন্ধ রেখে একটু গৃহবন্দি হয়ে লিখুন।
  3. এন্ডিং আগেই লিখে ফেলা: গল্পের শেষটা কেমন হবে, তার একটা খসড়া করে ফেলুন। এরপর মাঝের ফাঁকগুলো পূরণ করার চেষ্টা করুন।

চতুর্থ সপ্তাহের সবচেয়ে বড় শিক্ষা হলো, শেষ কয়েক দিনে আপনি হয়তো ১০,০০০ বা ১৫,০০০ শব্দ লিখে ফেলতে পারেন। এটা শুনতে অস্বাভাবিক লাগতে পারে, কিন্তু বাটি দেখিয়েছেন যে ডেডলাইনের চাপে মানুষ প্রায়শই নিজেদের সীমাবদ্ধতা ছাড়িয়ে যায়। শেষমেশ, ৩০ তম দিনে এসে যদি “৫০,০০০” লক্ষ্য অতিক্রম করতে পারেন, সেটিই হবে এক ধরনের বিজয়। বই বা গল্প সম্পূর্ণ নিখুঁত না হলেও, গুরুত্বপূর্ণ হলো আপনি একটি প্রথম খসড়া শেষ করলেন।

অভ্যন্তরীণ সমালোচক খসড়াপরবর্তী মানসিক অবস্থা

লেখা শেষ হওয়ার পর, বা প্রায় শেষ হওয়ার পর, প্রবল স্বস্তি ও আনন্দ অনুভূত হতে পারে। কিন্তু ঠিক এই সময়ে আরেকটি অনুভূতিও দেখা দেয়—“এ কী লিখলাম আমি!” চেহারায় হয়তো শূন্যতা, কনফিউশন, আবার খানিক উৎকণ্ঠা। নবম অধ্যায়ে বাটি বলে দিচ্ছেন কিভাবে এই স্বভাবসিদ্ধ আতঙ্ক বা সন্দেহকে সামাল দিতে হবে।

প্রথমত, আপনার “ইনার ক্রিটিক” আবারও মাথা তুলে বলতে পারে: “এত গুবলেট, এত ফাঁক, এটার কী হবে?” বাটি পরামর্শ দেন, অবিলম্বে পুরো পাণ্ডুলিপিটি না পড়াই ভালো। একে অন্তত দুই-তিন সপ্তাহের জন্য বিশ্রাম দিন। এই বিরতির ফলে আপনি গল্প থেকে সাময়িক দূরত্ব পেয়ে যাবেন এবং পরবর্তী সময়ে যখন পড়তে বসবেন, তখন অনেক বেশি নির্মোহ চোখে দেখতে পারবেন।

দ্বিতীয়ত, স্বীকৃতি দিন যে একটি প্রথম ড্রাফট স্বভাবতই অগোছালো হবে। এটাই স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। এই অবস্থায় কাজটি হলো স্বস্তি নেওয়া, একটু উদযাপন করা, এবং পরে সম্পাদনা ও সংকলনের ব্যাপারে প্রস্তুতি নেওয়া। বাটির সংলাপ: খসড়াটি অগোছালো বলে উৎকণ্ঠিত হবার কিছু নেই বরং খসড়াটা যে আছে সেটাই বড় সাফল্য; অনেকেই শুরুই করতে পারে না

সম্পাদনা, পুনর্লিখন, এবং দ্বিতীয় খসড়ার পথে

দশম অধ্যায়ে বাটি বুঝিয়ে বলেন কীভাবে এক মাসের ফ্রেনজি শেষে তৈরি হওয়া খসড়াকে একটি পরবর্তী স্তরে নিয়ে যাওয়া যায়। প্রথম ধাপ হলো “বড় ছবি” দেখা। এক-দুই সপ্তাহ বা তার বেশি সময় পাণ্ডুলিপি থেকে দূরে থাকার পর, আপনি যখন সেটি প্রথমবার পড়বেন, তখন মনোযোগ দিন গল্পের গঠন, চরিত্রের গতিপ্রকৃতি, থিম ও প্লটের ধারাবাহিকতায়।

বাটি পরামর্শ দেন, প্রথমেই যেসব অধ্যায় বা দৃশ্য আপনার গল্পের মূল বিন্দুতে অবদান রাখে না, সেগুলো সনাক্ত করুন। দরকার হলে এসব দৃশ্য বাদ দিতে দ্বিধা করবেন না। আবার কোথাও যদি চরিত্রের বিকাশ অপ্রতুল হয়, সেখানে নতুন অধ্যায় বা দৃশ্য যোগ করতে হতে পারে।

“লাইন এডিটিং” বা ভাষাগত ও বানান সংক্রান্ত সম্পাদনার আগে “স্ট্রাকচারাল এডিট” বা কাঠামোগত সম্পাদনা করাই যুক্তিযুক্ত। কারণ, কাঠামো বদলে গেলে একগাদা দৃশ্য নতুনভাবে লিখতে হতে পারে। তাই শুরুতেই বাক্য-পরিমার্জনা করলে পরে আবার সব পাল্টাতে হতে পারে। বাটি আরও বলেন, বিশ্বস্ত কিছু বন্ধু বা পাঠক খুঁজে নিতে পারেন যারা আপনার লেখা পড়ে গঠনমূলক সমালোচনা দিতে পারে। নিজের লেখা অন্যের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে কোথায় দুর্বলতা, কোথায় সম্ভাবনা—তা ভালোভাবে ধরা পড়ে।

কমিউনিটি দীর্ঘমেয়াদি লেখার অভ্যাস

একাদশ অধ্যায়ে বাটি লেখালেখির বড় কমিউনিটির গুরুত্ব আলোকপাত করেন। ন্যাশনাল নভেল রাইটিং মান্থ গোটা বিশ্বের অগণিত লেখককে একত্রে যুক্ত করে। ইন্টারনেট ফোরাম, স্থানীয় রাইট-ইন ইভেন্ট অথবা বন্ধুদের রাইটিং গ্রুপ—সবই একে অপরকে অনুপ্রেরণা জোগায়। এই কমিউনিটিভুক্ত হলে দেখা যাবে, আপনি একা নন—অনেকেই একই সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছেন, একই রকম দ্বিধা কাটিয়ে উঠছেন।

যারা এক মাসের এই বই-লেখা অভিযান শেষ করেছেন, তাদের অনেকেই এরপর স্থায়ী লেখার অভ্যাস গড়ে তোলেন। কেউ কেউ নতুন উপন্যাস শুরু করেন, কেউবা লেখার সময় কমিয়ে সপ্তাহে কয়েকদিন লেখালেখিকে অব্যাহত রাখেন। বাটি মনে করিয়ে দেন, “দৈনন্দিন” বা “সাপ্তাহিক” লেখার অভ্যাস একবার তৈরি হয়ে গেলে সৃজনশীলতার প্রবাহ অনেক সহজে চালু থাকে। যে হারানো বিশ্বাস—“আমি কি আদৌ লিখতে পারি?”—তা আর ফিরে আসে না, কেননা একবার আপনি ৩০ দিনে ৫০,০০০ শব্দ লিখে ফেলেছেন!

বইয়ের এই অংশে তিনি লেখকদের পরামর্শ দেন নিজেদের পাওয়া সাফল্য বা ব্যর্থতার অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিতে। কিছু মানুষ হয়তো ৫০,০০০ শব্দে পৌঁছতে পারেননি, কিন্তু ২০,০০০ বা ৩০,০০০ শব্দও আগের থেকে বিশাল অগ্রগতি। কমিউনিটি আপনার এই অগ্রগতিকে স্বীকৃতি দেবে, আপনাকে সাধুবাদ জানাবে, আর সেটিই আপনার পরবর্তী লেখায় আগ্রহী করে তুলবে।

উদযাপন, আত্মবিশ্লেষণ, এবংলেখক পরিচয়েরগ্রহণ

শেষ অধ্যায়ে বাটি বলেন, এক মাসের এই ম্যারাথন শেষ হওয়ার পর নিজেকে “উপন্যাসিক” পরিচয়ে মেনে নেওয়াই সবচেয়ে বড় সাফল্য। কারণ, অনেক সময় আমরা লেখক পরিচয় দিতে দ্বিধা বোধ করি—ধরে নিই, “আমি তো পেশাদার নই” বা “আমার বই তো কেউ পড়েনি।” বাটি মনে করিয়ে দেন, আপনি একটা পূর্ণাঙ্গ খসড়া শেষ করেছেন—সেটাই যথেষ্ট প্রমাণ যে আপনি লেখক।

তিনি পাঠকদের ছোটখাটো বা বড় করে উদযাপন করতে বলেন: হয়তো একটি পছন্দের রেস্টুরেন্টে খাবার খাওয়া, অথবা নিজের জন্য নতুন একটি বই কেনা। এই উদযাপন আপনার মনকে স্মরণ করিয়ে দেবে যে, সৃজনশীল পরিশ্রমের পর আনন্দ করা জরুরি। এরপর, যখন কিছু দিন বিরতির পর খসড়াটি নিয়ে বসবেন, তখন আত্মবিশ্লেষণ করে দেখবেন:

  • কোন সময়গুলোতে আপনি সবচেয়ে ভালো লিখতে পেরেছেন?
  • কী কী প্রতিবন্ধকতা এসেছিল এবং কীভাবে সেগুলো কাটিয়ে উঠেছেন?
  • ভবিষ্যতে আরেকটি উপন্যাস লিখতে গেলে কী কী কৌশল কাজে লাগানো যাবে?

সবচেয়ে বড় কথা, বাটি লেখার মৌলিক আনন্দ ও রোমাঞ্চকে বাঁচিয়ে রাখার তাগিদ দেন। “সুন্দর বাক্য” বা “বিক্রিত বই” ইত্যাদির আগে, আমাদের প্রয়োজন ছিল গল্প বলার সেই আদিম ও অকৃত্রিম ইচ্ছা। এক মাসের শিহরণকেন্দ্রিক লেখা এটা উপলব্ধি করায়—লেখালেখি নিছক পরিশ্রম নয়; এটি এক অন্য ধাঁচের অ্যাডভেঞ্চার।

No Plot? No Problem!এর স্থায়ী প্রভাব

No Plot? No Problem! এমন একটি বই, যা হাজারো মানুষের মনে “আমি কি পারবো?” প্রশ্নের বদলে “আমি তো ইতিমধ্যেই করে ফেলেছি!” আত্মবিশ্বাস প্রতিষ্ঠা করেছে। ক্রিস বাটির মূল মেসেজ: উপন্যাস লেখা কেবল পেশাদার, একাকী এবং নিখুঁত পরিকল্পনায় অভ্যস্ত মানুষের কাজ নয়—যে কেউ, যে কোনো পরিবেশে, এক মাসের দৃঢ় সংকল্পে ৫০,০০০ শব্দের প্রথম খসড়া নামিয়ে আনতে পারে।

বইয়ের প্রতিটি অধ্যায়েই পাঠককে মনে করিয়ে দেওয়া হয়েছে যে, “লেখার সময়” এবং “সম্পাদনার সময়” একইসাথে করা যায় না। প্রথমে কাঁচা সৃজনশীলতা বের করে আনুন, পরে তা শানিয়ে নিন। সেই সৃজনশীলতাকে আটকে রাখার অন্যতম বড় উপাদান হলো নিজের উপর আরোপিত কঠোর সমালোচনা এবং ‘পারফেকশন’ নামক মিথের পেছনে ছোটা। এটা যদি ৩০ দিনের জন্যও ঝেড়ে ফেলতে পারেন, দেখবেন আপনার ভেতরের কণ্ঠ কত অদ্ভুত, অজানা চরিত্র আর টানটান গল্পের পর্দা উন্মোচন করে।

পরবর্তীতে, রিভিশন ও সম্পাদনার মাধ্যমে সেই কাঁচা খসড়াকে একটা পরিপক্ক রূপ দেওয়া যেতে পারে। যদিও শেষপর্যন্ত সেটি প্রকাশিত হোক বা না হোক, এক মাসের মধ্যে একটি উপন্যাসের খসড়া লিখতে পারা মানেই নিজেকে নতুনভাবে আবিষ্কার করা। এটাই বাটির আসল শিক্ষা—আপনি নিজেকে “লেখক” ভাবতে সাহস করুন, তাহলে লেখার গতিও বৃদ্ধি পাবে।

সব মিলিয়ে, No Plot? No Problem! এক অর্থে সৃজনশীল মানুষের মহাকাব্যিক চ্যালেঞ্জ; স্বল্পসময়ের এক দুর্দান্ত উদ্যোগ, যেখানে আপনি আপনার কল্পনাশক্তি ও অধ্যবসায়ের পরীক্ষা নেন। এই অভিযানের শেষ প্রাপ্তি কেবল একটা ৫০,০০০ শব্দের পাণ্ডুলিপি নয়—বরং নিজের উপর আস্থা ও সৃজনশীল আনন্দকে পাকাপোক্তভাবে ধারণ করা।

সর্বশেষ সংক্ষিপ্ত কথন

ক্রিস বাটির এই বই একইসাথে অনুপ্রেরণা ও হাতেকলমে কৌশল শেখায়। এখানে যেমন আছে স্কেচ-আউট, রুটিন তৈরির প্রয়োজনীয়তা, তেমনি আছে বন্ধু-পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করার কৌশল। আছে কঠিন সময় পেরোবার লড়াইয়ের মানসিক টিপস, আবার আছে নিজেকে “বড় লেখক” ভেবে ভয় না পেয়ে, “অবসেসিভ” শব্দগুচ্ছ জমিয়ে যাওয়ার উপদেশ।

কাজেই, যারা মনে মনে উপন্যাস লেখার বাসনা পোষণ করছেন, কিন্তু বারবার ভাবছেন “প্লট আসছে না,” “কাহিনি জমছে না,” তাদের জন্য বাটি সরাসরি বলছেন, “প্লটের অভাব কোনো সমস্যা নয়—শুধু লেখায় বসুন।” লেখার পথে ফাঁক থাকবে, যুক্তিহীনতা থাকবে, অদ্ভুত বর্ণনা থাকবে—সেগুলোই পরে সঠিক সম্পাদনার জাদুতে ব্যাকরণসম্মত এবং সাহিত্যমানসম্মত হয়ে উঠবে। মূল ব্যাপার হলো আপনার গল্পকে শুরুর দিকে আলোর মুখ দেখানো।

এভাবেই No Plot? No Problem! অনেকের মধ্যে একটি শক্ত ধাক্কা দিয়েছে: “শুরু করে দাও—বাকিটা ক্রমে ঠিক হয়ে যাবে।” যারা সাহস করে ৩০ দিনের এই অভিযাত্রায় নামেন, প্রায় সবাই শেষমেশ স্বীকার করেন যে, উপন্যাস লেখা নিয়ে তাদের ‘ধারণা’ ও ‘শ্রদ্ধা’—দুইই বেড়ে গেছে। আর সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, তাদের অন্তরাত্মায় জন্ম নিয়েছে এক নতুন বিশ্বাস: আমি পারি

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top